কথা সামান্যই-প্রগতি বর্জনকারী প্রগতিশীলতা by ফজলুল আলম

বাংলাদেশে প্রগতিশীল কৃতবিদ্য মানুষের অভাব দেখি না। তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ পেশায় বা কর্মে নিয়োজিত আছেন বা ছিলেন, অনেকেই বিত্তবান, বেশির ভাগই (চলতি অর্থে) মধ্যবিত্ত, অনেকে সহনশীল দারিদ্র্যের মধ্যে চলছেন এমনও আছেন এবং তাঁদের অনেকেই বয়সে আর তরুণ-যুবক নন।
প্রগতিশীল তরুণ-যুবকও আছেন; তাঁদের অনেকেই লেখালেখিও করেন, অনেকে লিটল ম্যাগাজিনে প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার। পুরো দেশের ১৫ কোটি জনসংখ্যা বা ৯ কোটি সাবালক নর-নারীর তুলনায় এই প্রগতিশীলদের সংখ্যা অত্যল্প এবং তাঁদের চিন্তাভাবনার প্রকাশ গ্রহণ বা সমালোচনা করা ব্যক্তির সংখ্যাও খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। মাত্র কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও শক্তি আছে, তবে বাকি প্রগতিশীল ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও শক্তিশালীদের সঙ্গে ভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট- একটা সংশ্লিষ্টতা অবশ্যই রাজনৈতিক। আজকের রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা যে এসব প্রগতিশীল ব্যক্তির চিন্তাচর্চার খোরাক কিভাবে সংগৃহীত হয়েছে? এবং সেটা বাস্তব অবস্থা, বিশেষত দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তাঁদের প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার অবদান রাখার সুযোগ কত এবং সেসব কতটা উৎকৃষ্ট ও উপকারী? এবং তাঁদের সত্যিই প্রগতিশীল বলা যায় কি না?
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো রেজাল্ট করা, ভালো পদে চাকরি করা বা উচ্চ পেশাগত কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অনেকেই বইপত্র লেখেন, পত্রপত্রিকায় কলাম লেখেন, টেলিভিশনে বক্তব্য দেন, নাগরিক আন্দোলনে সোচ্চার হন, ইত্যাদি। আমরা বিচার করার চেষ্টা করি যে তাঁদের প্রগতিশীল বলা যায় কি না?
'প্রগতি' শব্দটির একটা প্রধান অর্থ 'জ্ঞানে বা কর্মে এগিয়ে চলা'। যাঁরা এই কাজটা যথাযথভাবে করতে সক্ষম, তাঁদেরই 'প্রগতিশীল' বলা হয়। এ ব্যাখ্যায় কর্মজীবনে সফল হওয়া ব্যক্তিদের অথবা যাঁরা প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁদের সবাইকে প্রগতিশীল বলা যায় কি? এক কথায় 'না' বলতে দ্বিধা হয়। কারণ তাঁদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে যাচ্ছেন তেমন ব্যক্তিরাও থাকতে পারেন। অনেক বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা ব্যক্তি খুব একটা সরব নন, তাঁদের বেশির ভাগই নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা স্বকীয় প্রগতিশীল চিন্তাধারায় নিমগ্ন এবং অন্যদের প্রগতিশীল মতকে যাচাইও করেন, উপযুক্ত মনে হলে যথাযথ স্বীকৃতি দেন। তাঁদের কাছে জ্ঞানের মধ্য দিয়েই উন্নতি সম্ভব, ব্যক্তির তো বটেই, দেশেরও এবং সেই জ্ঞানের আদান-প্রদানে কোনো দেয়াল তোলা অনুচিত। তাঁরা জানেন যে বিশ্বের সব দেশেই সমস্যা আছে, কিন্তু অনেক দেশই 'জ্ঞান' ও 'কর্মে' এগিয়ে গিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। ব্রিটেন ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সেসব দেশে রাষ্ট্র জনকল্যাণমুখী নীতিমালা (ওয়েলফেয়ার স্টেট পলিসি) নিয়ে সাধারণ, বিশেষত দরিদ্র মানুষের জীবনকে পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান- এই তিনটি ক্ষেত্রে তারা এক অর্থে অসাধ্য সাধন করে ফেলেছে এবং এই তিনটাই বিনা মূল্যে রাষ্ট্র সবাইকে দিতে পেরেছে; সেই সঙ্গে বেকারদের কর্মসংস্থানের এবং কর্মসংস্থানের আগে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যের ভার রাষ্ট্র নিয়েছে (যাঁরা ধনবান, তাঁরাও ইচ্ছা করলে এই সুবিধা নেন, তবে অধিকাংশই 'প্রাইভেট' ব্যবস্থা নিয়ে চলেন। এসব দেশে 'প্রাইভেট' ব্যবস্থা উৎপাটন করা হয়নি)।
এসব তারা করতে শুরু করে প্রথম মহাযুদ্ধের পর। এর পেছনে যে শুধু ব্রিটিশ ও ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব চিন্তাধারা ছিল, তা নয়। তাদের এই প্রগতিশীলতার খোরাক জুগিয়েছিল অন্য দেশের উদাহরণ। সেসব উদাহরণ তারা আত্তীকরণ করে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে প্রক্রিয়াজাত করেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এ ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় হয়েছে। আমরা দেখেছি, একমাত্র ব্রিটেনেই স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ডাক্তারের ঘাটতি পূরণের জন্য এশিয়া থেকে হাজার হাজার ডাক্তার সাদরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল- তাঁদের এক পার্সেন্টও আর স্বদেশে ফেরেননি। অন্য দেশের উদাহরণের কথা বলেছি, সেসবের মধ্যে একটা বড় উদাহরণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কমিউনিজমের নীতিমালায় রাষ্ট্র সব নাগরিকের দায়িত্ব নেবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থান সেসবের মধ্যে অগ্রাধিকার পাবে। এদিকে পশ্চিম ইউরোপে দরিদ্রদের সংখ্যা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সেখানে 'বিপ্লবে'র ভয় দেখা দিয়েছিল। একই বিপ্লবের ভয় সারা বিশ্বেই দেখা দিয়েছিল, এমনকি ভারতেও। ভারতে কমিউনিজম দমনে ভিন্ন (কঠোর আক্রমণাত্মক) নীতি গ্রহণ করলেও নিজ দেশে ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক শক্তি 'সাম্যে'র মূলনীতি অনুসরণ করে ও তাদের জনগণের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে।
আমি এটাকেই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রগতিশীলতার পরিচয় মনে করি। তার জন্য বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাও তারা করেছিল অনেক। এই উপমহাদেশে আমরা এখনো রবিঠাকুরের ভাষায় ইতিহাসের '...অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ধ্বংসস্তূপে' বিজড়িত। আমরা এ দেশে শুধু বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর দারিদ্র্যই দেখি। আমরা মনে করি, দুটি কারণে এই ভগ্নস্তূপে আমরা বাস করি, একটার কারণ ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ এবং দ্বিতীয়টি পাশ্চাত্যের শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নতি করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। তবু আমরা কি পারি না, শুধু পশ্চিমে না তাকিয়ে একটু পূর্বের দিকে তাকাতে? সেখানে দেখব আমাদের চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ঔপনিবেশিকতার 'অভিশাপ'কে অগ্রাহ্য করে প্রগতিশীলতার চর্চায় ও তাত্তি্বক জ্ঞানে প্রজ্ব্বলিত হয়ে কত দূর এগিয়ে গেছে ও যাচ্ছে!
আমাদের পাণ্ডিত্য ও চিন্তাচর্চা অতি ক্ষুদ্র ও বর্জিত বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে- আমরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে রাজনীতি করি না বা অর্থনীতির সমস্যার সমাধান করি না। আমরা ঔপনিবেশিক দাস মনোবৃত্তিতে এখনো ভুগছি বলে একটি বিশ্বশক্তির কাছে পদানত হয়ে আছি। আমরা বিকল্প পথ খুঁজতে ভয় পাই। কারণ আমাদের পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, শ্রম রপ্তানি বিপর্যস্ত হতে পারে, ইত্যাদি- অথচ আমরা ভাবি না যে এসব কর্মকাণ্ডে আমাদের 'ধ্বংসস্তূপ' থেকে উদ্ধার পাওয়ার চাবিকাঠি নেই, যেমন নেই ঋণ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের হাজার ব্যর্থ কৌশলে। আমাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার খোরাক সংগ্রহে আমরা চক্ষু মেলে বিশ্বের প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করি না সজ্ঞানেই; হাতে গোনা কয়েকজন যাঁরা সে পথে যান, তাঁদের আমরা সমাদর তো করিই না, বরঞ্চ নিচে ঠেলে দিতে এগোই- সেটাও করি সজ্ঞানেই। আমরা প্রগতিশীলতা বর্জন করে প্রগতির পথে যেতে চাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.