নদীমুখের উৎসবিস্তৃতি ও ড্রাফট সংরক্ষণ by হাসান কামরুল

নদীবিধৌত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের দুর্যোগ ঝুঁকি রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঝুঁকি নিরসনে নদীর ভূমিকা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ গাঙ্গেয়-বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবিলায় সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এ অঞ্চলের মানুষের প্রতিনিয়ত লড়াইয়ে সাহস জুগিয়েছে।
বন্যা, খরা, অতি খরা বা ফ্লাশ ফ্লাডের অবধারিত অভিজ্ঞতার ঝুলি মাথায় নিয়েই বেড়ে উঠছে এ দেশের আঞ্চলিক জীবন। জীবন নির্বাহে জীবিকার খোঁজে এ দেশ যেমন নদীনির্ভর কৃষি অর্থনীতির বলয় গড়ে তুলেছে বছরের পর বছর ধরে, ঠিক তেমনি নদীর কারণে ঘর ছেড়েছে বহু মানুষ। নদীভাঙনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চারকারী লোকের সংখ্যাও কম নয়। একদিকে নদীর সঞ্চিত পলি আধারে সঞ্চারিত হয়ে পলল সমভূমির আকার ও আকৃতির পরিসর লোভনীয়ভাবেই বৃদ্ধি করে চলছে। আর অন্যদিকে নদীর ভাঙনের গর্জনে নির্ভার মানুষের হাহাকার করা মুখ সমুদয় অর্থেই অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গন্তব্যহীন ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। বাংলাদেশের খরস্রোতা নদীর ভিন্ন ভিন্ন চেহারা ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপিত। ব্রেডেড (braided) রিভারের উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব বিদ্যমান যমুনা নামক বৃহৎ নদীটিতে। এ নদীর বৈশিষ্ট্য হলো পানি প্রবাহের মুখে চর ফেলে নদীর স্রোতের অবস্থানকে প্রাকৃতিকভাবেই ঘুরিয়ে দেওয়া। সাধারণত শান্ত প্রকৃতির এ নদীটিও অঞ্চলভেদে অশান্ত হয়ে ওঠে, ফলে যমুনার ওপর দিকে ভাঙনপ্রবণতা যতটা পরিলক্ষিত নিচের দিকে ততটা নয়। তাই যমুনার ভাঙনপ্রবণ এলাকা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে তা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে।
মেঘনার উৎপত্তি ওপরের দিকে অর্থাৎ আসামসর্বস্ব হলেও এর প্রবহমান দিক সুরমা-কুশিয়ারা সিস্টেমে। যা ওপরের দিকে শান্ত প্রকৃতির কিন্তু মেঘনার নিচের দিকটা ভাঙনপ্রবণতা লক্ষণীয়। বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে শুরু করে চাঁদপুর কিংবা লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত ২১টি ভাঙনপ্রবণ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব এলাকাকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নদীর বাঁধরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার সরকারি কৌশল বিদ্যমান।
পদ্মা অন্যতম উৎসে বিবর্তনে দীর্ঘতম ও বৃহৎ নদীর নাম। পদ্মার উৎসমুখ এক সময় ভাঙনপ্রবণ ছিল কিন্তু এখন আর তার দেখা মেলে না। কারণ পদ্মার কোলজুড়ে বিশাল চরের সমাহারের কারণে পদ্মার পানি এখন পদ্মা নদী থেকে পদ্মা নালায় পরিণত হয়েছে। তবে পদ্মা এমন একটি নদী, যেখানে যমুনা নদীর আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রবাহ রয়েছে আবার পদ্মার প্রবাহ চাঁদপুর অঞ্চলে মেঘনার সঙ্গে মিলে উপসাগরে জলের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। এভাবে তিনটি বৃহৎ নদীর জলবিস্তৃতির হার বিনিময় হচ্ছে যা থেকে ছোট ছোট শাখা উপশাখা বা উপনদীগুলো বিভিন্ন নামে বিভিন্নভাবে দেশজুড়ে নদ-নদীর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশের নামের আগে নদীমাতৃক শব্দটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। তবে বাংলাদেশের নদীগুলোর উৎস আন্তর্জাতিক হওয়ায় নদীশাসনে ওপরের দেশগুলোর ক্রমাগত হস্তক্ষেপের কারণে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে নিম্নাঞ্চলের এ দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। জলযোগ ও জলবিচ্ছিন্ন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে শুরু হয়েছে হাইড্রোপলিটিক্স, যা জিও পলিটিক্সের অন্তর্গত অংশ-২ হিসেবে পরিগণিত। জিওপলিটিক্সের ক্রমাগত অংশ-১-এ পেট্রোডলারের রাজনীতি লুক্কায়িত। এখন পানি গবেষকদের ধারণা, আগামী শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে পানির চাহিদা তেলের চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাবে। এর কারণও আছে যথেষ্ট পরিমাণে। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ যেখানে জল, সেখানে জলের অভাবে পৃথিবী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে, তা কি ভাবা যায়। এই তিন ভাগ জলের মাত্র দুই শতাংশ জল সরাসরি মানুষের কাজে লাগে। অর্থাৎ এই দুই শতাংশ জলই হলো স্বাদু পানি বা মিষ্টি পানি। আর মিষ্টি পানির আধার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যে কারণে পানি এখন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হচ্ছে। আজ থেকে মাত্র সিকি শতাব্দী আগেও কেউ ভাবতে পারেনি যে দেশীয় বাজারে বোতলজাত পানির বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব। আধা লিটার পানি ১৫ টাকায় কিনে খাবে- এমনটা ছিল ধারণারও অতীত। নদ-নদীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও নদীর অস্তিত্ব দিন দিন বিলুপ্তির পথে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের ছোট মাপের প্রায় ৫০টি নদী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমনকি বড় নদীগুলোও বিলুপ্তির মুখে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পদ্মার উপরিভাগের আলাতলী ও শিবগঞ্জের কথা, অর্থাৎ বাংলাদেশে পদ্মার বিস্তৃতি যে পথে সে পথ এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ পদ্মায় জমাট বাঁধা চরগুলো। এক সময় মহাবিস্তৃতি নিয়ে রাজশাহীর ওপর দিয়ে এ পদ্মা তিলোত্তমা পদ্মা হিসেবে বাংলাদেশে আচড়ে পড়ত। রাজশাহী অঞ্চলের মানুষজন নদীর ভাঙনের মুখে অনেকেই নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সেই পদ্মা এখন আর চোখে পড়ে না। একই অবস্থা মেঘনা ও যমুনার বেলায়। বিআইডাবি্লউটিএর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাস্টার প্লানে দেখা যাচ্ছে, মেঘনার গড় গভীরতা ২ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার। অর্থাৎ মেঘনার ড্রাফট ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বৃহৎ নদীগুলোর সংরক্ষিত ড্রাফট বিবেচনায় নিলে কয়েক বছর পর এ নদীগুলো লাইটার ভেসেল তো দূরের কথা, ইঞ্জিনচালিত বোটও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। যে করেই হোক নদী বাঁচাতে হবে, এটা এখন আর স্লোগান নয়, সত্যি সত্যি নদীগুলোর ড্রাফট পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। ড্রাফট সংরক্ষণে সরকারের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল, বাস্তবে এখন পর্যন্ত সে পরিকল্পনার কিয়দংশ বাস্তবায়িত হয়নি এমনকি চোখে পড়ার মতো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি বলেই প্রতীয়মান। অথচ এটার খুব দরকার ছিল। ছোট নদীগুলোর ড্রাফট সংরক্ষণের আগে বৃহৎ নদীগুলোর ড্রেজিং করা বাঞ্ছনীয়। কারণ বৃহৎ নদীগুলোর শাখা-উপশাখা-উপনদীর নেটওয়ার্ক হলো ছোট ছোট অসংখ্য নদ-নদী। যদি বৃহৎ নদীতে পানির প্রবাহ না থাকে, তাহলে শাখা বা উপনদীতে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা উল্টো পথে হাঁটছে। কারণ শাখা নদীগুলো যেভাবে ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে সেভাবে কিন্তু বৃহৎ নদীগুলোতে ড্রেজিং কার্যকর গ্রহণ করা হয়নি। তাই সর্বোপরি বাংলাদেশের বৃহৎ নদীগুলোর ড্রাফট পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ ছাড়া বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ড্রেজিং পয়েন্ট চিহ্নিত করে খনন কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ
hkgeologist@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.