ঐতিহ্যের শহর বাগেরহাট by ফারিহা আফসানা

বাংলাদেশের দণি-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। সুন্দরবন ও খুলনা শহর আর অসংখ্য নদী নালা রয়েছে এর চতুর্পাশে। বাগেরহাট নামকরণের ইতিহাসে রয়েছে নানা মতো।
কারও কারও মতে, বাগেরহাটে সুন্দরবনের একটা বড় অংশ থাকায় বাঘের উপদ্রব ছিল বেশ। এ জন্যই একে বাঘেরহাট বলা হতো। কালক্রমে বাঘেরহাট বাগেরহাটে পরিণত হয়। এছাড়াও অনেকের মতে, হযরত খানজাহান আলীর প্রচুর বাগান ছিল বলে হয়ত বাগেরহাট নাম হয়। আবার প্রচলিত আছে, দাড়টানা নদীর তীর ঘেঁষে বসত বড় বাজার ও হাট। এ জন্যই বাগান বা বাগ এবং হাটের সংমিশ্রণে বাগেরহাট নামকরণ হয়। এখানে মুসলিম স্থাপত্যের অসংখ্য নিদর্শন আজও ইতিহাসের সাী। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এলাকাটি রথ দেখা আর কলা বেচার মতোই।
ষাট গম্বুজ মসজিদ : বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ। আনুমানিক ১৪৪০ সালে হযরত খানজাহান আলী (রা.) মসজিদটি নির্মাণ করেন। বাংলাদেশের প্রাচীন আমলের মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহৎ এই মসজিদটি ১৯০৪ সালে সর্বপ্রথম সংস্কার করা হয়। উত্তর-দেিণ লম্বা এই মসজিদের আয়তন বাইরের দিকে ১৫৯ ফুট ৮ ইঞ্চি *১০৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। আর ভেতরের আয়তন ১৪৩ ফুট ৩ ইঞ্চি * ৮৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। ইট নির্মিত দেয়ালগুলো প্রায় ৯ ফুট প্রশসত্ম। মসজিদের চারকোণে চারটি বরম্নজের ওপর ৪টি গম্বুজসহ মোট ৭৪টি গম্বুজ আছে এবং মধ্যের সারিতে বাংলা চারের মতো ৭টি চৌ-চালাসহ মোট ৮১টি গুম্বুজ আছে। এর প্রার্থনা করে চৌ-চালা ছাদ, গম্বুজগুলো ইট ও পাথরের ৬০টি খাম্বাদ্বারা সমর্থিত। খিলানের ওপর নির্মিত এই ইমারতটিতে তুঘলক স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে। নামকরণের পেছনেও বেশ কয়েকটি গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যটি হলো খানজাহান আলীর সময় ফার্সি ভাষা চালু ছিল। ফার্সি ভাষায় সত্মম্ভ বা পিলারকে গম্বুজ বলে। তাই মসজিদের ষাটটি পিলার বা সত্মম্ভ থেকে এর ষাট গম্বুজ মসজিদ নামকরণ করা হয়। অন্য এক মত থেকে জানা যায়, মসজিদের সাত সারি গম্বুজ থাকায় সাত থেকে ষাট গম্বুজ নাম হয়েছে। খানজাহান আলীর মাজারও রয়েছে মসজিদের কাছাকাছি।
জাদুঘর : ষাট গম্বুজ মসজিদের পাশেই অবস্থান বাগেরহাট জাদুঘরের। বাংলাদেশের দণি-পশ্চিমাঞ্চলের ৬শ' বছরের পুরনো মুসলিম আমলের প্রত্নসম্পদ, প্রাচীন ঐহিত্য স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে। ৩টি করে প্রথমটিতে পনেরো শতকের সুলতানি আমলের প্রাচীন শহর খলিফাতাবাদ থেকে প্রাপ্ত কিছু প্রত্নসম্পদ এবং ২ নং ক েবারোবাজার থেকে প্রত্নতাত্তি্বক খননের ফলে প্রাপ্ত প্রত্নসম্পদ এবং অন্যটিতে বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মুসলিম স্থাপত্যের আলোকচিত্র রয়েছে।
খানজাহান আলী (রা.) মাজার : বাগেরহাট শহরের পাশেই রয়েছে খানজাহান আলী (রা.)-এর মাজার। মাজারের গায়ে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, এই মহান সাধক ৮৩৩ হিজরির ২৬ জিলহজ বুধবার ইংরেজী ২৩ অক্টোবর ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে মৃতু্যবরণ করেন। কথিত আছে যে, তিনি যশোরের বারোবাজার থেকে শুরম্ন করে সমগ্র ভাটি অঞ্চলে ৩৬০টি মসজিদ এবং ২৬০টি দীঘি খনন করেন। অত্যনত্ম মনোরম ও ষাট গম্বুজ মসজিদের আদলে গড়া মাজারটি বর্গাকারে ৪২ ফুট * ৪২ ফুট এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। ছাদের রয়েছে একটি গম্বুজ। প্রতিবছর হাজার হাজার মুসলমান তাঁর মাজার জিয়ারতে আসেন।
খাঞ্জেলী দীঘি : খানজাহান আলীর মাজারের দণি পাশে ৩৬০ বিঘা জমি নিয়ে অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই বিখ্যাত দীঘির নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। বুদ্ধ ঠাকুরের মূর্তি প্রাপ্তির জন্য এর নাম হয় ঠাকুরদীঘি। আবার অন্য মতে, হিন্দু ভক্তরা খানজাহান আলীকে ভক্তি ভরে ঠাকুর সম্বোধন করতেন বলে এর নাম হয় ঠাকুরদীঘি। তবে এখন খাঞ্জেলীর দীঘি নামেই বেশি পরিচিত। এর প্রশসত্ম ও সুন্দর ঘাট রয়েছে। মহিলাদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ঘাট। তবে এই পুকুরেই একমাত্র মিঠা পানির কুমির রয়েছে। এগুলো কালা পাহাড় ও ধলা পাহাড়ের বংশধর, যা ডাকলেই সাড়া দেয়। এটির পানি অত্যনত্ম সুপেয়। অনেকে রোগ নিরাময়ের জন্যও এ দীঘির পানি সংগ্রহ করে।
এছাড়া বাগেরহাট শহরের আশপাশে রয়েছে আরও অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। এগুলো থেকে মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির নিদর্শন সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক এসব কীর্তির মধ্যে রয়েছে তিন গম্বুজ মসজিদ, ঐতিহাসিক সিংগার মসজিদ, চিলস্না খানা মাজার, জিন্দাপীরের মাজার, নয় গম্বুজ সমজিদ, বারো গম্বুজ মসজিদ ও জোড়া দীঘি।

No comments

Powered by Blogger.