১৯৭১ ॥ চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ by সামসুদ্দিন আহম্মদ

১৯৭১ সাল। গণআন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার ঘোষণার পর তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে চট্টগ্রামের আম জনতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ থেকে ৬ মার্চ সারাদেশে হরতাল ডাকার পাশাপাশি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভা আহ্বান করলেন। ২ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে লাগাতার হরতাল পালিত হলো। অতঃপর ৩ মার্চ পালিত হলো জাতীয় শোক দিবস। রাজধানী ঢাকা শহরে রাতে সান্ধ্য আইন বলবত ছিল, তবে চট্টগ্রামে তখন সান্ধ্য আইন জারি ছিল না। চট্টগ্রাম শহরের পরিস্থিতি ছিল ভীতিকর ও থমথমে। সকাল-সন্ধ্যা ছাত্র, শ্রমিক, রাজনীতিক ও জনতার সম্মিলিত মিছিলের শহরে পরিণত হলো চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম শহরে অবাঙালী কলোনি বেশি হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বেসামরিক পোশাকে অবাঙালী কলোনিগুলোতে ঢুকে তাদেরকে প্রচুর সমরাস্ত্র সরবরাহ করে। ৩ মার্চ সর্বপ্রথম ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ওয়্যারলেস কলোনিতে ঢুকে পড়ে। বাঙালী অধু্যষিত পাহাড়তলী ও ঝাউতলা এলাকায় সর্বপ্রথম গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানী সেনারা। বর্বর সেনাদের হাতে সেদিন অনেক বাঙালী মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
বেলুচ রেজিমেন্ট সর্বপ্রথম একটি শ্রমিক মিছিলের ওপর গুলি চালায়। চট্টগ্রাম শহরে বিহারীদের কলোনির সংখ্যা বেশি হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সুবিধাজনক অবস্থান ছিল। এলাকাগুলো হলো : ওয়্যারলেস কলোনি, আমবাগান, পাহাড়তলী কলোনি, খুলসি কলোনি, শেরশাহ কলোনি, সরদারনগর, বৃহত্তর হালিশহর কলোনি, বিবিরহাট কলোনি, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহায়তায় অবাঙালীরা পার্শ্ববর্তী বাঙালী বস্তিসমূহে আগুন লাগিয়ে দিল। এই ঘটনার খবর চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে পড়ার পর নগরবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে অবাঙালীদের হামলা প্রতিরোধ করার জন্য ছাত্র-জনতা ও শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
ইতোমধ্যে এমআর সিদ্দীকী, এমএ হান্নান ও ডা. জাফরের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বাঙালী সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সাথে আলোচনা করে চট্টগ্রাম শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার অবাঙালী কলোনিগুলোতে তাৎণিকভাবে ইপিআর ও পুলিশ মোতায়েন করেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বাঙালীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। আগে থেকেই তিনি পাকিস্তানীদের কূটচাল টের পেয়েছিলেন। পুলিশ ও ইপিআর মোতায়েনের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। তখনকার ইপিআরের সদর দফতর হালিশহরের নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালী ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। তিনি আগে থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে যোগাযোগ রা করে আসছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কলোনিগুলোতে ইপিআর সদস্যরা অবাঙালীদের গতিবিধির ওপর নজরদারি শুরু করে। মার্চের শুরু থেকেই তাদের মনোভাব ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ সুপার সামসুল হক অসহযোগ আন্দোলন থেকেই রাজনীতিবিদ ও ছাত্র- জনতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। তিনি সব সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমএ হান্নান, ডা. জাফর, ছাত্রলীগ থেকে শওকত হাফিজ খান রশ্নি এবং আমাকে পুলিশ সুপারের সঙ্গে সর্বণিক যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যেহেতু আমার বাসা ছিল টেরিবাজারে অবস্থিত যা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ অফিস থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে এবং তার অল্প দূরেই রুশ্নির বাসা। আর আওয়ামী লীগ অফিসের ২০ গজ দূরে হাজারী গলির বিনোদা ভবনে ছিল ছাত্রলীগের অফিস। এই কারণে আমাদের ওপর গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। আমরা সব সময় পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ রা করতাম। এজন্য হান্নান ভাই ও ডা. জাফর সব সময় অফিসগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য কিছু দায়িত্ব ও দিক-নির্দেশনা দেন। আমাদের কাছ থেকে এসএম জামালউদ্দিন ও খালেক চাচা সব সময় খবরাখবর সংগ্রহ করে তা নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
৯ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পুলিশ সুপার সামসুল হকের অফিসে আমি এবং রুশ্নি ভাই যাই। তার আগে পুলিশ সুপার খবর পেয়েছিলেন শেরশাহ কলোনিতে গোলযোগ দেখা দিয়েছে। আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শেরশাহ কলোনিতে রওনা দেন। ওখানে গিয়ে দেখি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে আগে থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন। এসপি সাহেব আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আমাদের কাছ থেকে শহরের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলেন। তিনি আমাদেরকে কিছু উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়ে বললেন, পাকিস্তানী সৈন্য ও অবাঙালীদের আচরণ সন্দেহজনক। তাই আমরা যেন সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকতে বলি। তিনি আরও বললেন, পুলিশ প্রশাসন আমাদের সহায়তায় আছে। শহর থেকে কোন মজুতকৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং বিভিন্ন লকারে রতি অস্ত্রশস্ত্র যেন পাকিস্তানীদের হস্তগত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাঁর ওই নির্দেশনা পেয়ে আমরা শহরের আন্দরকিলস্নায় অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে বিসত্মারিত নির্দেশনার কথা এমএ হান্নান ও ডা. জাফরকে জানালাম। কালবিলম্ব না করে হান্নান ভাই, এমএনএ আবু সালেহর কাছে বেশকিছু দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি যেন পুলিশ সুপারের সাথে যোগাযোগ করে রাতের বেলায় বন্দুকের দোকান ও অস্ত্রের গুদাম পাহারার ব্যবস্থা করেন।
এদিকে মীর্জা মনসুর এমপির নেতৃত্বে শহরে প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের নিয়ে আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ, পলোগ্রাউন্ড, প্যারেড ময়দান এবং সব খেলার মাঠে ছাত্র-শ্রমিক-জনতাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২০ মার্চ সকালে একজন অবাঙালী অফিসার কিছু ইপিআরসহ তিনটি ট্রাক নিয়ে আন্দরকিল্লার বন্দুকের দোকানে সামনে গিয়ে উপস্থিত হন। এর পর ঝটপট করে দোকানের রক্ষিত অস্ত্রশস্ত্র ট্রাকে তুলে নেন। আমরা আর দেরি না করে পুরনো টায়ার যোগাড় করে লালদীঘির উত্তরপাড়, জেনারেল হসপিটালের গেট এবং টেরিবাজারের মুখে আগুন জ্বালানো শুরু করি। টেরিবাজারের মুখে ছিল একটি পুলিশ ফাঁড়ি। শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে তিন রাস্তা‘র মুখে সমবেত হলো। আমাদের সৌভাগ্য পুলিশ ও বাঙালী ইপিআর সদস্যরা আমাদের প্রতি আগে থেকেই অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিল। বেলা ৩টা পর্যন্ত ট্রাকগুলো অবরোধে ছিল। উপায়ান্তর না দেখে অস্ত্রগুলো দোকানের ভেতরেই রাখার জন্য সমঝোতা হলো। অবশ্যই ডবল তালা মেরে। দোকানের একটি চাবি থাকবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে আর অপর চাবিটি থাকবে পুলিশ প্রশাসনের কাছে। এর পাশাপাশি পুলিশী পাহারার ব্যবস্থাও করা হলো।
আমরা সব সময় পুলিশ সুপার ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজের সাথে যোগাযোগ রা করতাম। কোন উচ্চপদস্থ বাঙালী সামরিক অফিসারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিলো না। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দোকানে মজুত অস্ত্রগুলো কিভাবে হস্তগত করা হবে তার জন্য মরহুম এমএ আজিজের ছোটভাই এমএনএ মজিদ মিয়ার বাসায় একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় ডা. মাহফুজের নেতৃত্বে সব অস্ত্রশস্ত্র দোকান থেকে আমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.