বোরোচাষির সমস্যা-উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে নজর দিতে হবে

উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের অসামঞ্জস্যের কারণে বোরো চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে কৃষক। তাই বলে কৃষকের জমি খালি পড়ে থাকছে এমন নয়। কিন্তু বিকল্প চাষের কারণে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণসহ কৃষকের লাভ-লোকসানের হিসাবে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
বোরো চাষের পরিমাণ সাধারণত বছরভেদে ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমবেশি হয়ে থাকে। কিন্তু এবার সেই হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প ফসলের উৎপাদন এবং চাহিদা পূরণে এর ভূমিকা ও কৃষকের লাভ-লোকসানের হিসাব নতুনভাবে করতে হচ্ছে। বোরো ধান চাষ কমিয়ে সরিষা, গম ও ভুট্টা চাষ হওয়ায় আপাতত মনে হতে পারে, খাদ্য চাহিদা পূরণে সেগুলোও ভূমিকা রাখবে এবং এসব পণ্য আমদানির মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, তা সাশ্রয় হবে। প্রকৃতপক্ষে সেই সুযোগের সম্ভাবনা কম। কারণ দেশের চালের চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি পূরণ হয় বোরো ধানের মাধ্যমে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকের সাফল্যেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বোরো উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে চালের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। উৎপাদন ব্যয় পুষিয়ে আনতে পারছে না বলে কৃষকরা এবার ৩০ হাজার হেক্টর কম জমিতে বোরো চাষ করছে। চাষের পরিমাণ কমে আসায় স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কম হবে। পাশাপাশি এবার আবহাওয়াগত দিক থেকেও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। সাধারণত বর্ষা শেষ হওয়ার পরপর মাটিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তাই শীত মৌসুম স্বল্পস্থায়ী হলে জমি চাষে কৃষক অধিক সুবিধা পায়। দীর্ঘস্থায়ী শীতের কারণে এবার কৃষক সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই এবার তাদের এত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে বোরো আবাদের জন্য। এই বিলম্বিত আবাদের প্রতিক্রিয়া পড়বে উৎপাদনের ক্ষেত্রে। জমিতে অধিক সেচ প্রয়োজন হবে এবার। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের পূর্ণ নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি এখনো। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিংও বেড়ে যাবে এবং এর প্রভাব পড়বে সেচকাজেও।
অন্যদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের জন্য জ্বালানি তেলের ব্যবহার করেও কৃষক ক্ষতি পুষিয়ে আনতে পারছে না। কারণ গত বছরের তুলনায় জ্বালানি তেলের দামও এবার অনেক বেশি। ফলে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, সেখানে বোরো আবাদ তুলনামূলক বেশি কমেছে। বীজ সরবরাহের ক্ষেত্রেও কৃষককে হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে। সরকারি সহযোগিতা নিয়ে এবার কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। খোলাবাজার থেকে বীজ কিনে চাষের শুরুতেই অধিক ব্যয়ের ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে তাদের, যা সরাসরি উৎপাদন ব্যয়ে যোগ হবে।
এসব প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনা করে বোঝা যায়, এবার বোরো ধানে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। এ আশঙ্কা দূর করতে হলে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। ঘোষণা অনুযায়ী, সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ বোরো উৎপাদনের বড় উপাদান হচ্ছে বিদ্যুৎ। অন্যদিকে কীটনাশক, সারের সরবরাহ ও মূল্যহ্রাসের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বোরো আবাদের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা অপরিহার্য।

No comments

Powered by Blogger.