রংপুরে ৯ কোটি টাকায় এতিম পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতি by সরকার মাজহারুল মান্নান

রংপুরের কাউনিয়ায় প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দুস্থ এতিম প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ছাবেরা খাতুন ইসলামিয়া শিশু সদনের তিনটি সরকারি ভবন নির্মাণে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।
এখন এগুলো হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, দুই এসও এবং সংশ্লিষ্ট তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি তদন্তে গঠিত টিমের রিপোর্টের আগেই এ জন্য তারা প্রকল্প পরিচালক বরাবরে চেক লিস্ট প্রদান করেছেন। অন্য দিকে তদন্ত কমিটির প্রধান বলছেন, এখনো তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। তদন্ত রিপোর্টের আগে ভবন হস্তান্তর করার কোনো নিয়ম নেই। দুর্নীতির এ ঘটনায় সমাজসেবা অধিদফতর ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বল্লভ বিশু গ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে এই শিশু সদন নির্মাণের জন্য এলজিইডির তত্ত্বাবধায়নে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্প অনুযায়ী ৮ কোটি ৭৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩০ টাকা ব্যয়ে দু’টি পাঁচ তলার ডরমেটরি এবং একটি চার তলার স্কুল কাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১১ সালের ১ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করে এলজিইডি। টেন্ডারের মাধ্যমে ১ নম্বর বিল্ডিংটি গাইবান্ধার সাইদুর রহমান, দ্বিতীয় বিল্ডিংটি রাজশাহীর বালিয়াপুকুর ঘোড়ামারা এলাকার আলম কনস্ট্রাকশন এবং তৃতীয় বিল্ডিংটির ওয়ার্ক অর্ডার পায় রংপুর মহানগরীর জুম্মাপাড়ার লাবু আহমেদ। সাইদুর রহমান নিজে কাজটি করলেও আলম কনস্ট্রাকশন কাজটি কাউনিয়ার মুন্না শফি এবং লাবু আহমেদ কাজটি লালমনিরহাটের জাহিনুরের কাছে বিক্রি করে দেন। প্রথম বিল্ডিংটি চলতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর, ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিল্ডিং এবং ৩০ জুন তৃতীয় বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ শেষে হস্তান্তর হওয়ার কথা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিশু সদনের তিনটি ভবন নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। একেবারেই নিভৃত পল্লীতে হওয়ার সুযোগ নিয়ে এলজিইডির রংপুর অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদের যোগাসাজসে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, এসও আমিনুল ইসলাম ও বশির উদ্দিন এবং তিনটি ঠিকাদারি  প্রতিষ্ঠান এতিমদের লালন-পালন সদনটির ভবন নির্মাণে নজিরবিহীন অনিয়ম দুর্নীতি করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিডিউল অনুযায়ী কাজ তো হয়ইনি, বরং দৈর্ঘ্যে ৩ ফিট ও প্রস্থে ২ ফিট ৬ ইঞ্চি ছোট করে বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়। শিডিউলে বিল্ডিংয়ের গ্রেট বিম ও পিলারে ২০ মিলি রডের ডায়া দেয়ার কথা থাকলেও ১৮ মিলি রড এবং ছাদের ঢালাই সার্টারে ১০ মিলি রডের পরিবর্তে ৮ মিলি রড দেয়ায় বিল্ডিংটির ভেতরে ধরেছে ফাটল। দরজা-জানালার ফ্রেমে সিলকড়ই অথবা চাপালিশা এবং  পাল্লায় চিটাগাং টেক কাঠ দেয়ার নির্দেশ থাকলেও তা অসার মাল্লা কাঠে তৈরির পর প্রাইম কোড দিয়ে রঙিন করে লাগানো হয়। ফলে দরজা-জানালায় পচন ধরে। সিঁড়ির হাতলে চিটাগাং টেক কাঠের পরিবর্তে অসার ও কাঁচা মেহগনি কাঠ দেয়া হয়। তাতে ছত্রাক ধরেছে। কলাপসিবল গেট এবং দরজা-জানালার গ্রিল শিডিউল বহির্ভূত অ্যাঙ্গেল রড দিয়ে তৈরি এবং রেড অক্সাইড না দেয়ায় সেগুলোতে জং ধরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও শিডিউল বহির্ভূতভাবে ২ নম্বর ইট, নিম্নমানের সিমেন্ট, ডালিয়ার বালির পরিবর্তে পুকুরের নিম্নমানের বালি, সিমেন্টের পরিমাণ কম দিয়ে বালির পরিমাণ বেশি দেয়া এবং কিউরিং না করার কারণে পুরো বিল্ডিংটিতে ফাটল ধরে। শিডিউলে বিল্ডিংয়ে পানি সরবরাহের জন্য ৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের আজিজ ন্যাশনাল পাইপ লাগানোর নির্দেশ থাকলেও ৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের নিম্নমানের আনোয়ার পাইপ লাগানো হয়। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের ওয়াল ও সøাবও এখনই ভেঙে যাচ্ছে। জিইসি ডিলাক্স ফ্যানের পরিবর্তে টঙ্গীর নিম্নমানের ন্যাশনাল ফ্যান, নিম্নমানের বৈদ্যুতিকসামগ্রী, বেসিন, টিউবলাইট, সোলার সিস্টেমে অনিয়ম করা হয়।

অনিয়মের বিষয় জানিয়ে সদনের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সংসদ সদস্য, এলজিইডি এবং প্রকল্প পরিচালক বরাবরে লিখিত আবেদন করেও কোনো কাজ হয়নি। বরং তাকেসহ এলাকাবাসীকে র‌্যাব পুলিশের ভয় দেখিয়েছেন ঠিকাদার ও প্রকল্পের সাথে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা। এমনকি আবেদন উপেক্ষা করেই এলজিইডি ফাইনাল বিল দিয়েছে ঠিকাদারদের।

গত ৪ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে ‘এতিমদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন ভবন নির্মাণে শুভঙ্করের ফাঁকি, নির্বাহী প্রকৌশলী, পিডি, উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার ও এসওদের দেড় কোটি টাকার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে প্রকল্পটি নির্মাণে নজিরবিহীন অনিয়ম বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে বাস্তবায়ন হওয়ায় সংবাদটি তার নজরে আসে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিষয়টি তদন্তের জন্য এলজিইডিকে নির্দেশ দেয়া হয়। তার নির্দেশে তদন্ত কমিটির প্রধান এলজিইডির রংপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ শরীফুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ ও আঞ্চলিক অফিসের সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে প্রথম দফা ১০ অক্টোবর এবং দ্বিতীয় দফায় ১৭ সেপ্টেম্বর দিনভর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় পরে আবারো তদন্তে যাবেন বলে জানান তিনি।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: শরীফুজ্জামান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত এখনো সমাপ্ত হয়নি। আরো তদন্ত করা হবে। এরপরই রিপোর্ট প্রদান করা হবে। তারপর বিল্ডিংটি হস্তান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি জানান, তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রত্যেকটি বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। এ দিকে অনুসন্ধানে জানা দেছে, বিল্ডিংটির অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত চলাকালীন সময়েই উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান, দুই এসও এবং ঠিকাদারেরা উঠেপড়ে লেগেছেন। অনিয়মের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তদন্ত কমিটির রিপোর্টের আগেই নির্বাহী প্রকৌশলীও বিল্ডিংটি হস্তান্তরের পাঁয়তারা করছেন।

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ সম্প্রতি শিশু সদনে আসেন এবং সরেজমিন পরিদর্শন করে অনিয়মের বিষয়গুলো অবহিত হন। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি শিশু সদনের সার্বিক বিষয় পরিদর্শন করেন। বিল্ডিং নির্মাণের তদারকিতে অনিয়মের অভিযোগে প্রকল্প পরিচালক হারুণ অর রশিদের বিরুদ্ধে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে মামলা করারও প্রস্তুতি চলছে।

এ ব্যাপারে সদনের সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন জানান, যে সব বিষয়ে তদন্তের জন্য আমরা অভিযোগ করেছি সেসব বিষয়ে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু তার আগেই পিডির কাছে বিল্ডিং হস্তান্তরের অনুমোদিত প্লান ও ডিটেইল ইস্টিমেট ছাড়াই চেক লিস্ট প্রদান করা হয়েছে। এ ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, নিয়মানুযায়ী হস্তান্তর করা হবে। অন্য দিকে উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান জানান, ‘কিভাবে কেমন করে হস্তান্তর করা হবে সে বিষয়ে সাংবাদিকদের জেনে লাভ নেই। তদন্ত তদন্তের জায়গায় আছে। কে কী তদন্ত করল তা আমার দেখার বিষয় নয়।’

No comments

Powered by Blogger.