নিজামী মুজাহিদ সাঈদী যে কোন সময় গ্রেফতার- ফারুক হত্যা মামলায় হুকুমের আসামি করা হচ্ছে, রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে by শংকর কুমার দে

জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি রেজাউল করিমকে যে কোন সময় গ্রেফতার করা হতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেনকে খুন করে ম্যানহোলে ফেলে লাশ গুম ও ছাত্রলীগ কর্মীদের রগ কেটে হাতুড়ি বাটাল দিয়ে মারাত্মক জখম করার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় জামায়াত_শিবিরের এসব নেতাকে হুকুমের আসামি করা হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রয়েছে এসব জামায়াত_শিবির নেতা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত_ শিবিরের নৃশংস সন্ত্রাসী তা-বলীলা চালানোর আগের দিন জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী রাজশাহীতে গিয়ে এই ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে উস্কানি দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে তদনত্মে। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও রেজাউল করিমের মোবাইল টেলিফোনে কথোপকথনের কললিস্ট পরীৰা করে প্রমাণ পেয়েছে তদনত্মকারীরা। সে মোতাবেক আসামিদের গ্রেফতারে মাঠে নামে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দারা। গত ২৬ ফেব্রম্নয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় র্যাবের হাতে হাবিবুর রহমান হলের ছাত্র শিবিরের সভাপতি রাইজুল ইসলামও গত ৭ মার্চ আমির আলী হল শাখার ছাত্র শিবির সভাপতি মোহাম্মদ ইকরাম হোসাইন র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা সাংবাদিকদের সামনে অবলীলায় জামায়াত_শিবিরের এসব নেতার হুকুমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকা-, রগকাটা ও সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানো হয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দেয়। পরে তারা র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।
মোহাম্মদ ইকরাম হোসাইন গ্রেফতার হওয়ার পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রাতের নৃশংসতার যে বর্ণনা দিয়েছে, তা '৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াত-শিবিরের পৈশাচিক বর্বরতার কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই রাতে ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেনকে প্রথমে পেছন থেকে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। তারপর চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর রগ কেটে হাতুড়ি শাবাল রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে পুলিশের সামনেই তার লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেয়া হয়। ছাত্রলীগের অন্য কর্মীকেও বিভিন্ন হল থেকে ধরে এনে একইভাবে রগ কেটে, হাতুড়ি, শাবল দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করার সময় আহতরা তাদের পায়ে পড়ে আকুতি মিনতি করেছে। হত্যাকা-ের পর শিবিরের নেতাকর্মীরা রাতের বেলায় খাওয়া দাওয়া করে মিটিং শেষে জামায়াত_শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী আত্মগোপনে চলে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে ইকরাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রাতের ঘটনার ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেন হত্যাকা-, ছাত্রলীগ কর্মীদের রগকাটা ও সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর ব্যাপারে দায়ের করা দু'টি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোহাম্মদ ইকরাম হোসাইন।
ইকরাম হোসাইন তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেন হত্যাকা- ও রগকাটা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি শামছুল আলম গোলাপের নেতৃত্বে ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র দল ৫টি গ্রম্নপে ভাগ হয়ে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হামলা চালায়। যে ৫টি গ্রম্নপ হামলা চালিয়েছে তারা হচ্ছে শামছুল আলম গোলাপ গ্রম্নপ, মোবারক হোসেন গ্রম্নপ, সাইফুদ্দিন গ্রম্নপ, হাফেজ মাসুদ গ্রম্নপ, আনিছ গ্রম্নপ। প্রতিটি গ্রম্নপে ৩০-৩৫ জনের সশস্ত্র ছাত্র শিবিরে ক্যাডার অংশগ্রহণ করেছে। ইকরাম ঘটনার পর জানতে পারে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল শাখার ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি আনিসের রডের আঘাতে ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেন খুন হয়েছে। ফারম্নক হোসেনকে যখন চুলের মুঠি ধরে টানা হ্যাচড়া করে ধরে আনা হয় তখন সে 'বাঁচাও-বাঁচাও' চিৎকার করে পায়ে ধরে ্আকুতি মিনতি করেছে।
সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রাতের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন। র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রশিদুল আলম, গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান, লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েলসহ র্যাব কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। র্যাব কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ইকরাম হোসাইন সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা করে জানায়, ৭ ফেব্রম্নয়ারি রাতে রাজশাহীর জামায়েতে ইসলামীর এক নেতার বাড়িতে গোপন বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে সে নিজেও উপস্থিত ছিল। বৈঠকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ইসলামী ছাত্র শিবিরের সব নেতা উপস্থিত ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত ও বাধা দিলে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। বৈঠকের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি শামসুল আলম গোলাপ জামায়েতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ রেজাউল করিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করার জন্য নির্দেশ দেয় তারা। হামলার সময়ে প্রশাসন কিংবা কেউ বাধা দিলে তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়।
ইকরাম হোসাইন জানায়, গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি রাত অনুমানিক ১২টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল শাখায় হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেনকে হত্যা, ছাত্রলীগ কর্মীদের রগকাটা, হাতুড়ি-শাবল-রড দিয়ে পিটানো, অগি্নসংযোগ, ভাংচুর শুরম্ন করা হয়। রাত প্রায় ৩টার দিকে জামায়েতে ইসলামীর স্থানীয় এক নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনে কর্মরত কাটাখালীর হামিমের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র শিবির সভাপতিসহ অন্যদের সঙ্গে সে নিজেও অবস্থান নেয়। সে সময় শিবিরের বিতর্ক সম্পাদক শিহাবের কাছে সে জানতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় এসএম হল শাখার ছাত্র শিবির সাবেক সভাপতি আনিসের রডের আঘাতে ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেন খুন হয়েছে। ফারম্নক হোসেন তখন বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি জানিয়ে বাঁচতে পারেনি বলে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃত ইকরাম হোসাইন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল শাখার সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমান, এসএম হল শাখার বর্তমান সভাপতি আহাদ, সাধারণ সম্পাদক বাপ্পি, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবিরের বির্তক সম্পাদক শিহাব, প্রশিৰণ সম্পাদক সুমন গাজী, শিবির নেতা দেলোয়ার হোসেন মিলে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেনের লাশ গুম করার সিদ্ধানত্ম নেয়। সিদ্ধানত্ম অনুযায়ী ফারম্নকের লাশ মরা গরম্নর মতো টানাহেঁচড়া করে গেট পর্যনত্ম নিয়ে যায় তারা। তারপর লাশ ফেলে দেয়া হয় ম্যানহোলে। লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেয়ার সময় দায়িত্বরত এক পুলিশ দেখে ফেলে ঘটনাটি। পুলিশ সদস্য লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেয়ার দৃশ্যটি দেখেও না দেখার ভান করে চলে যান। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশন শেষ হওয়ার পর নেতাদের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করে সবাই। ভোর ৬টার দিকে শিবিরের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে স্থানীয় এক জামায়াত নেতার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার মতো চলে যায়। ইকরাম জানিয়েছে, সে গত ৯ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ধামরাই এলাকার তার এক ভাইয়ের আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গত ৮ ফেব্রম্নয়ারি রাত ৮টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দফায় হামলার প্রায় ২ ঘণ্টা আগে জামায়াত-শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা ঘটনাটি মনিটরিং করা শুরম্ন করেন। দ্বিতীয় দফায় হামলা করার আগে জামায়াত-শিবিরের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। দায়িত্বরত পুলিশ দল বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার পর দ্বিতীয় দফা হামলার আগে শিবিরের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের কথা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই রাতের আক্রমণ পরিচালনাকারী ও মাঠ পর্যায়ের জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী, ক্যাডারদের মোবাইল টেলিফোনের কথোপকথন ও তথ্য উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে এই ধরনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজশাহীর ঘটনার রাতে সারা রাত জামায়াত-শিবিরের নেতাদের মধ্যে কথোপকথন ও খোঁজখবর নেয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিবির সভাপতি শামছুল আলম গোলাপ কিছুৰণ পর পর ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা রেজাউল করিমের সঙ্গে মোবাইল টেলিফোনে কথা বলেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাবেক নেতা দেলোয়ার হোসেন আক্রমণের আগ মুহূর্ত থেকে শেষ পর্যনত্ম শিবির ক্যাডারদের দিক নির্দেশনা দিয়েছে মোবাইল ফোনে। ওই রাতে ঢাকা থেকে শিবির ক্যাডার কাফি রাজশাহীতে পেঁৗছেছে বার্তা নিয়ে। কাফি রাজশাহী যাওয়ার সময়ে মোবাইল ফোনে আক্রমণ সংক্রানত্ম কথাবার্তা বলে যোগাযোগ করেছে।
গোয়েন্দারা মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীৰা করে দেখতে পেয়েছেন, শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজাউল করিম ওই রাত প্রায় আড়াইটায় জামায়েতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলেছেন। এরপর রেজাউল করিম জামায়াতের ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন ওই রাতে। রফিকুল ইসলাম খান তাঁর আগের রাতে ফোন করেছিলেন জামায়েতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে। তাঁরা কথা বলেন প্রায় তিন মিনিট। আলী আহসান মুজাহিদ নিজেও তার পরের দিন ভোর ছয়টায় ফোন করেছেন শিবির সভাপতি রেজাউল করিমকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুল আলম গোলাপের সঙ্গে ঢাকা মহানগর জামায়েতের আমির রফিকুল ইসলাম খান ও প্রচার সম্পাদক তাসনিম আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীৰা করে এসব ঘটনা সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকতারা জানিয়েছেন, জামায়াত-শিবিরের নেতাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারম্নক হোসেনকে হত্যা ও ছাত্রলীগ কর্মীদের রগকাটা, লাশগুম, অগি্নসংযোগ, ভাংচুর, হল দখলের ঘটনায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যে কোন সময় জামায়াত-শিবিরের এসব নেতাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তাদের গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.