ধর্ম- রোজা মানুষের অহংকার জ্বালিয়ে দেয় by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

রোজা মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় গর্ব, অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফেসর দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এই মহিমান্বিত মাসের নাম ‘রমজান’। এই মাসে রোজাদারদের দম্ভ বা অহমিকা প্রদর্শন তাকে হীন ও নীচু এবং সমাজে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় করে তোলে।


মানুষ বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে অহংকার করে থাকে, যা ইসলামের পরিপন্থী বিনয় ও নম্রতার সম্পূর্ণ বিপরীত। সমাজে কেউ বংশের গৌরব করে, কেউ নিজের বংশকে উঁচু মনে করে গর্ববোধ করে এবং অন্যদের নিচু বংশের লোক মনে করে হেয় ও তুচ্ছজ্ঞান করে। কোনো কোনো বিত্তশালী লোক তার অর্থবিত্ত ও ধনসম্পদের গর্ব করে। নারীরা সাধারণত রূপ-সৌন্দর্যের বড়াই করে থাকে। ক্ষমতাবান লোকেরা তাদের ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও পদমর্যাদার অহংকার করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এসবের জন্য গর্ব বা অহংকার করার কিছুই নেই। প্রকাশ্য অহংকারের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তুমি চালচলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নীচু করো।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৮-১৯)
মানবচরিত্রে যেসব দোষত্রুটি রয়েছে, তন্মধ্যে গর্ব ও অহংকার একটি অত্যন্ত জঘন্য স্বভাব। এটি ইসলামি নৈতিকতা ও মূলনীতির পরিপন্থী। অহংকার শুধু একটি কবিরা গুনাহই নয়; বরং এটি আরও অনেক কবিরা গুনাহের জন্মদাতা। কারণ এটি মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে বাধা দেয়, অন্ধকারের পথে পরিচালিত করে এবং পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়। অহংকার মানে অহমিকা, দম্ভ, বড়াই, নিজেকে বড় মনে করা, গৌরববোধ করা প্রভৃতি।
পৃথিবীর সব মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি আদমের সন্তান। সুতরাং বংশের গৌরব মানুষের কৃত্রিম সৃষ্টি। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বলে আল্লাহ দয়া করে সবকিছু তাঁর অধীন করে দিয়েছেন। সম্পদ মানুষের চিরস্থায়ী নয়। ধনসম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ, মানুষ আমানতদার মাত্র। সম্পদ মানুষের জন্য পরীক্ষার বস্তু; এসব নিয়ে গৌরব করার কিছু নেই। মানুষের রূপ-সৌন্দর্য আল্লাহপ্রদত্ত, যাকে যেমন খুশি সৃষ্টি করেছেন। ক্ষমতার অহংকার করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা কারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। আজ যে রাজা, কাল সে প্রজা। এসব কিছুর প্রকৃত মালিক মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, যিনি সর্বশক্তিমান। ক্ষমতার অহংকার করা তাঁরই সাজে, মানুষের নয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তুমি বলো, হে আল্লাহ, তুমি সাম্রাজ্যের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করো এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও, যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করো এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করো, কল্যাণ তোমার হাতেই, নিশ্চয়ই তুমি প্রত্যেকের ওপর শক্তিশালী।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-২৬)
গর্ব-অহংকার মূলত আল্লাহর অধিকার। মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি, ধনসম্পদ, শক্তি-সামর্থ্য—সবকিছুই অত্যন্ত সীমিত। কোনো মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অভাবমুক্ত নয়। সবারই কোনো না কোনো অভাব-অনটন ও অসম্পূর্ণতা আছে। একমাত্র আল্লাহই অভাবমুক্ত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। অহংকার বা গর্ব করা একমাত্র আল্লাহরই শোভা পায়, অন্য কারও নয়। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘অহংকার আমার পরিচ্ছদ, এই পোশাক যে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করে, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (মুসলিম)
অহংকার মানে নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা, অন্যদের নিজের তুলনায় ক্ষুদ্র ও অধম মনে করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তাঁর অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করা—এসবই অহংকারের লক্ষণ ও তার আওতাভুক্ত। রোজাদার অনেক সময় পরস্পরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে, অহংকারবশত হেয় ও তুচ্ছ জ্ঞান করে। হয়তো তার মধ্যে এমন ভালো গুণাবলি আছে, যা তারা জানে না, সে হয়তো তার চেয়েও উত্তম। আর আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে তাকে অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে পারেন। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (সা.) ছিলেন নিরহংকারের মূর্ত প্রতীক। তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, তাঁকে জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করা হয়েছিল; কিন্তু তিনি ধৈর্যহারা হননি। আবার আল্লাহ যখন মক্কা বিজয় দান করলেন, তখনো তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে অহংকার করলেন না; বরং বিনয় ও নম্রভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে অত্যাচারীদের ক্ষমা করে দিলেন।
অহংকারীর কতিপয় বৈশিষ্ট্য হলো, সে নিজে যা পছন্দ করে, অন্যকে তা পছন্দ করতে দেয় না। সাধারণত সে বিদ্বেষপরায়ণ হয়। কোনো উপদেশকারীর উপদেশ গ্রহণ করতে পারে না; বরং উল্টো তার ঠাট্টা-বিদ্রূপের শিকার হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলা ও চলার সময় হিংসা-বিদ্বেষ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও গর্ব-অহংকারের ভাব প্রকাশ করে। অহংকার বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রবেশ করে বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ, জাতীয়তা ও সম্পদের প্রাচুর্যের ওপর মানুষকে মাতিয়ে তুলেছে। যদিও এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি; তথাপি এগুলো কোনো মর্যাদার মানদণ্ড বা মাপকাঠি নয়। প্রকৃতপক্ষে অহংকারীরা আল্লাহর আনুগত্য করে না। তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে কঠিন শাস্তি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারীর অন্তরে মোহর লাগিয়ে দেন।’ (সূরা আল-মুমিন, আয়াত-৩৫) তাই জান্নাত লাভ করতে হলে রোজাদারদের অন্তরকে পরিচ্ছন্ন ও অহংকারমুক্ত করতে হবে। অহংকারী ব্যক্তি জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম)
অহংকার সামাজিক শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিনষ্ট করে। অহংকারী ব্যক্তিকে কেউ আদৌ পছন্দ করে না। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে গর্ব-অহংকারের ভয়াবহ পরিণাম ও পরিণতির কথা বিবৃত হয়েছে এবং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় হারামও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। এসব থেকে প্রকৃত রোজাদারদের সব সময় দূরে থাকতে হবে। তাই ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মাহে রমজানসহ মানবজীবনের সর্বাবস্থায় গর্ব ও অহংকার অবশ্যই চিরতরে বর্জন করা উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.