চিকিৎসা-বিজ্ঞান- হুমায়ূন আহমেদের ক্যানসার কেমোথেরাপি by ইফতেখারুল ইসলাম

উন্নত দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যানসার হাসপাতাল থেকে শুরু করে আমাদের দেশের সাধারণ হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার কেমোথেরাপি মোটামুটিভাবে একই রকম। ওষুধগুলো দামি, তাই চিকিৎসাও ব্যয়সাধ্য। তবে বাংলাদেশের যেকোনো হাসপাতালে আমাদের স্থানীয় ক্যানসার বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার খরচ নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল


স্লোন কেটারিংয়ের তুলনায় অনেক কম, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু আমাদের অতি প্রিয় লেখক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে আরোগ্য অথবা কিছুদিনের জন্য নিরাময় পেলে আমরা খুবই সন্তুষ্ট ও আনন্দিত বোধ করতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই আশাহত হয়েছি, চিকিৎসার দ্বিতীয় পর্যায়ে অপারেশনের পর হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন। তাঁর পরিবার-পরিজন আর অগণিত পাঠকের জন্য রইল অন্তহীন শূন্যতা আর বিষাদ।
অপারেশনের আগে, কেমো নেওয়ার পর কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সে বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই কথা বলেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। কী ওষুধ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তার পুরো তালিকা আমরা দেখিনি, তবে প্রধান একটি ওষুধের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন লেখায় ও আলোচনায়। এলোক্সাটিন নামের এই ওষুধটি একটি প্লাটিনাম যৌগ। এ ছাড়া আর কী কী ওষুধ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল? সব মিলিয়ে এগুলোর কী কী কার্যকারিতা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে? এই বিষয়গুলো অনুসন্ধান করে দেখার জন্য প্রথমেই কোলন ক্যানসারের কেমোথেরাপির সম্ভাব্য পন্থাগুলো বুঝে নেওয়া দরকার।
বৃহদন্ত্রের ক্যানসারের চিকিৎসায় বিভিন্ন পর্যায়ে কেমোথেরাপির ব্যবহার হয়ে থাকে। সাধারণত রোগের অবস্থা, পর্যায় ইত্যাদি বিবেচনা করে তিন পদ্ধতির যেকোনো একটি বেছে নেওয়া হয়। তিনটি পর্যায়ে কেমোথেরাপি দেওয়া যায়।
এক. এডজুভেন্ট চিকিৎসা (অপারেশনের পর), যাতে করে বিশেষত দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্টেজের ক্যানসারকে অপারেশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দূর করার পর এর পুনরাবির্ভাবের আশঙ্কা কমানোর চেষ্টা করা হয়।
দুই. নিও-এডজুভেন্ট চিকিৎসা (অপারেশনের আগে), যার মাধ্যমে ক্যানসার কোষগুলোকে সংকুচিত করে অপারেশনের কাজটাকে সহজ করে তোলা হয়।
তিন. অগ্রসর ক্যানসারের কেমো সাধারণত সেই সব রোগীকে দেওয়া হয়, যাদের দেহে ক্যানসার অন্ত্র থেকে অন্যান্য অঙ্গে, বিশেষ করে যকৃতে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন রোগীর ক্যানসার সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না, তবে ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে সংকুচিত ও ছোট করে ফেলে রোগীকে আরও বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখাই এই চিকিৎসার লক্ষ্য।
কেমোথেরাপির জন্য বেশ কিছু ওষুধ থাকলেও রোগের পর্যায় বিবেচনা করে ওষুধ নির্বাচন করার পদ্ধতি মোটামুটিভাবে সর্বজনগ্রাহ্য। যেহেতু কেমোথেরাপির পর অপারেশন করা হয়েছিল, তাই আমরা অনুমান করতে পারি, এটা সম্ভবত ছিল অগ্রসর ক্যানসারের চিকিৎসা অথবা নিও-এডজুভেন্ট পদ্ধতির কেমো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যানসার চিকিৎসায় কয়েকটি ওষুধের সমন্বয়ে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। অনুমাননির্ভর হলেও ধরে নেওয়া যায়, হুমায়ূন আহমেদের জন্য যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর সমন্বিত নাম ফলফক্স। এতে আছে তিনটি ওষুধ—ফাইভ-ফ্লুরোইউরাসিল, লিউকভরিন ও অক্সালিপ্লাটিন।
ফাইভ-ফ্লুরোইউরাসিল দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত, প্রাচীন ও পরীক্ষিত একটি ওষুধ, যার কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য লিউকভরিন নামের ভিটামিন প্রয়োজন হয়। আর অক্সালিপ্লাটিন তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক একটি ওষুধ, যা অন্ত্র থেকে অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার চিকিৎসায় কার্যকর। এই ওষুধসমষ্টি শিরাপথে প্রয়োগ করা হয় ক্যানসার কোষগুলোকে মেরে ফেলার জন্যই। এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কার্যকারিতা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এদের কার্যকারিতার প্রধান কৌশলটি হচ্ছে দ্রুত বিভাজনরত ও বেড়ে ওঠা ক্যানসার কোষগুলোকে মেরে ফেলা। এই কর্মকৌশলের কারণেই কেমোথেরাপির ওষুধ শরীরের অন্যান্য অংশের দ্রুত বেড়ে ওঠা সুস্থ কোষগুলোর প্রভূত ক্ষতি করে। এ ধরনের দ্রুত বর্ধিষ্ণু কোষ বেশি থাকে আমাদের মুখগহ্বরের ভেতরকার আবরণে এবং পরিপাকতন্ত্রের ভেতরকার আবরণ স্তরে। এর ফলে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মূলত এই অঙ্গগুলোরই ক্ষতিসাধন করে। সবচেয়ে বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বিবমিষা ও বমি, ক্ষুধা হ্রাস, চুল পড়ে যাওয়া, মুখের ভেতরের ঘা, হাত ও পায়ের রেশ, ডায়রিয়া এবং রক্তকণিকার সংখ্যা হ্রাস। অস্থিমজ্জা থেকে রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেই সব ধরনের রক্তকণিকা কমে যায়। শ্বেতকণিকা কমে যাওয়ার কারণে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়, প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় বলে সামান্য কারণেই কাটা-ছেঁড়া ও রক্তপাত ঘটতে পারে, আর লোহিতকণিকার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় গভীর অবসাদ।
নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুর ব্যথা অক্সালিপ্লাটিনের অন্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এতে হাত ও পায়ে অবশ ভাব এবং ব্যথা হয়। একজন লেখকের চিকিৎসায় এই ব্যাপারটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে বলেই বিষয়টি বিশদভাবে হুমায়ূন আহমেদকে বুঝিয়ে বলেছিলেন তাঁর ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। বেশির ভাগ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বল্পস্থায়ী এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে, তবে হাত-পায়ের অবশভাব বেশ কিছুদিন স্থায়ী হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব প্রতিক্রিয়া ঠিক করার জন্য প্রয়োজন হয় আলাদা চিকিৎসার। বেশির ভাগ রোগীর কেমোথেরাপি শুরু করার আগে থেকে চিকিৎসা চলাকালীন পুরো সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য স্টেরয়েড এবং আরও দু-একটি ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এদেরও আবার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া আছে, যদিও ক্যানসারের তুলনায় এসব ঝামেলাকে ছোট করেই দেখা হয়।
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি বলছে যে বেশি বয়সের রোগীও এ ধরনের কেমোথেরাপি সহজেই সয়ে নিতে পারেন। তাই কোনো অবস্থাতেই বয়সের কারণে চিকিৎসা বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। সে তুলনায় হুমায়ূন আহমেদের বয়স তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না। তবু একদিকে ক্যানসার ও মৃত্যু নিয়ে সার্বক্ষণিক ভাবনা, অপর দিকে প্রবল বমি, দ্রুত সব চুল পড়ে যাওয়া, হাত অবশ হয়ে যাওয়া—এ রকম কষ্ট যাকে সইতে হয়নি, তার পক্ষে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ কয়েক মাসের যন্ত্রণা ও সংগ্রামকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তাঁর ওই সময়ের বিভিন্ন ছবিতে, মুখের রেখায় এবং চোখের ভাষায় অনিশ্চয়তা আর বেদনাবোধের অভিব্যক্তি সহজেই চিহ্নিত করা যায়। কেমোথেরাপির যন্ত্রণাকে লেখক তাঁর প্রাণশক্তি দিয়ে সয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর অপারেশন, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং আরেকটি অপারেশন দ্রুত তাঁকে কাবু করে ফেলে। আমরা তাঁকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান, কিন্তু তাঁর গত ১০ মাসের সংগ্রাম ও সাহসিকতার তুলনা নেই।
ইফতেখারুল ইসলাম: ফার্মাসিস্ট, একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.