আলীমের নির্দেশে পাকি সেনা ও রাজাকাররা অসংখ্য বাঙালীকে হত্যা করে- যুদ্ধাপরাধী বিচার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষী টিআইবি চেয়ারম্যান, তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল তাঁর জবানবন্দী প্রদান করবেন ১০ সেপ্টেম্বর।


সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ দিন ধার্য করে। তবে ২৭ আগস্ট থেকে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে। একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার জেরা অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী আব্দুল মোমেন জবানবন্দীতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান আব্দুল আলীমের নির্দেশে পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জয়পুরহাটের অসংখ্য বাঙালীকে হত্যা করে। তিনি নিজেও কয়েকটি হত্যা ও গণহত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ তিনি এই জবানবন্দী প্রদান করেছেন। একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৪র্থ সাক্ষী আবুদল মান্নান জবানবন্দীতে বলেছেন, তিনি শুনেছেন, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনা ও আলবদর সদস্যরা শেরপুরের একটি গ্রামে পালিয়ে থাকা সেনা সদস্য বদিউজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের অপর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৬ষ্ট সাক্ষী সাফি উদ্দিন মোল্লার জেরা শেষ হয়েছে। বুধবার (৮ আগস্ট) সপ্তম সাক্ষীর জবানবন্দী প্রদান করবে।
গোলাম আযম
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তৃতীয় সাক্ষী দিতে সোমবার ট্রাইব্যুনালে এসেছিলেন টিআইবির চেয়ারম্যান ও তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ট্রাইব্যুনালে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর জবানবন্দী গ্রহণ না করে পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পরবর্তী সাক্ষীর দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ সেপ্টেম্বর।
সোমবার সকালে অধ্যাপক গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। শুরুতেই প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সুলতানা কামালের উপস্থিতির কথা বলেন। এ সময় ট্রাইব্যুনাল জানায়, আগে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা শেষ করি। পরবর্তী দিন দেবার পর গোলাম আযমকে আবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দী প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন (৬১)। এরপর দ্বিতীয় সাক্ষী এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ তাঁর জবানবন্দী দেন। ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-১। ১১ জানুয়ারি গোলাম আযম ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন জানান। এ আবেদন নাকচ করে দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
সাঈদী
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনকে জেরা অব্যাহত রয়েছে। সোমবার তাঁকে ৪৩দিনের মতো জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে-১ তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা চলছে। আজ আবার তাঁকে জেরা করা হবে।
আব্দুল আলীম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত পরে জামিনে থাকা বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী আব্দুল মোমেন তাঁর জবানবন্দীতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান আব্দুল আলীমের নির্দেশে পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জয়পুরহাটের অসংখ্য বাঙালীকে হত্যা করে। তিনি নিজেও কয়েকটি হত্যা ও গণহত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন।
সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি এই জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দী শেষে তাঁকে জেরা করেন আসামি পক্ষের অইনজীবী আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান। সাক্ষীকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।
জবানবন্দীতে আব্দুল মোমেন বলেন, আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি ১৯৫৫ সালে বগুড়া আজিজুল কলেজ থেকে। ১৯৫৪ সালে ঐ কলেজে ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। তেজগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৫৭ সালে ডিপ্লোমা পাস করি। রাজনীতির কারণে ১৯৬৯ সালে গ্রেফতার হই। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল মুক্তি পাই।
তিনি জবানবন্দীতে বলেন, এই মামলার আসামি আব্দুল আলীম জয়পুরহাটে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাবেক স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর কনভেনশন মুসলিম লীগে উনি যোগ দান করেন। এবং ৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে জামায়াত নেতা আব্বাস আলী খানের সঙ্গে তিনি পরাজিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত ড. মফিজ চৌধুরীর নিকট।
তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নিরঙ্কুশ সমর্থন পান। আমি জেল থেকে শুনেছি, জয়পুরহাট সংগ্রাম কমিটি গঠন হলো। আব্দুল আলীম কনভেনশন মুসলিম লীগের তিনি জয়পুরহাটের শান্তিকমিটি গঠন করেন এবং তার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। জেল থেকে বের হয়ে দেখলাম, ক্ষেতলাল থানা এবং হাইস্কুল মাঠে পাক সেনারা ক্য্ম্পা স্থাপন করেছে। সম্ভবত মে মাসের ঘটনা। এর আগে জয়পুরহাট শাওন লাল বজলার গদিঘরে শান্তিকমিটির অফিস এবং রাজাকারদের অফিস ছিল। এখানে আলীম সাহেব নিজেই রাজাকারদের রিক্রুট করতেন। সেখানে রাজাকারদের অফিস ছিল গদিঘরে।
সাক্ষী তাঁর জবানবন্দীতে আরও বলেন, আব্দুল আলীমের বাসা রাস্তার এপার-ওপার। শাওন লাল বজলার গদিঘর মেজর আফজাল জয়পুরহাটের পাকবাহিনীর দায়িত্ব ছিল। এবং এখানে তার অফিসও ছিল। আব্দুল আলীম তার নেতৃত্বেই শাওন লাল বজলার গদিঘরে ওই সকল অফিস হয়েছিল। এর পর ১৯৭১ সালে রোজার ঈদের কিছুদিন আগে একটা জীপ গাড়িতে আলীম ও মেজর আফজাল ক্ষেতলাল থানার হাটশহর হাটের বেলা ৩টার দিকে উপস্থিত হন। সঙ্গে পাক আর্মি, রাজাকার এবং স্থানীয় ইউপির শান্তিকমিটির নেতা মৃত মোঃ আলী, মৃত সোলেমান মেম্বার উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ৫/৬ শ’ ইউপি থানা শান্তিকমিটির লোকজন ছিল। এখানে মেজর আফজাল উর্দুতে বক্তুতা দেয়। আব্দুল আলীম আফজালের বক্তৃতা বাংলায় তরজমা করে। তারপর আলীম নিজেই বক্তৃতা করেন। আলীম সেই বক্তৃতায় বলেন, ‘আগামী ঈদের নামাজ কলকাতা গড়ের মাঠে পড়ব।’ হিন্দুদের মালামাল যা আছে তা লুট করে নাও।
এই সভার ৩০/৪০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আমি তা শুনতে পাই। এই মিটিং কোন মাসে অনুষ্ঠিত হয় তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। মিটিং-এর ৭/৮ দিন পর বেলা ৮/৯টার দিকে আমি হাটশহর হিন্দু পল্লীতে পবন বাবুর বাড়িতে যাই। এখান থেকে জানতে পারি পাকিস্তানী পাক সেনা, কিছু রাজাকার, শান্তিকমিটির সদস্য এই হাটশহর গ্রামের সবদিকে ঘিরে ফেলে। এখানে বাদল, শচীন, ভানু, বিষু, প্রভাস চন্দ্র শীল, মনি ভূষণ চক্রবর্তী, কার্তিক, নিতাই, প্রিয়নাথকে পাকি সেনারা ধরে ফেলে। এবং ক্ষেতলাল শান্তিকমিটি অফিস হাসপাতাল এরিয়ায় পুরনো ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়। এখানে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়।
তার পর সেখান থেকে তাদের জয়পুরহাট মহকুমা শান্তিকমিটির শাওন লাল বাজলার গদিঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আব্দুল আলীম শান্তিকমিটি অফিসে ছিলেন। তিনি বাইরে এসে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। তখন পাক সেনারা, শান্তিকমিটি ও রাজাকার সদস্যরা খঞ্জনপুর কুড়িবাড়িতে নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দিয়ে রাখে। আমি ক্ষেতলাল থেকে এদের অনুসরণ করি। জয়পুরহাট মহকুমা শান্তিকমিটি অফিস এবং খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাট পর্যন্ত অনুসরণ করি। এই আটককৃত লোকগুলো আমার পরিচিত ছিল। এর পর সাক্ষীকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী।
সাক্ষীর প্রশ্ন
আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী এবার আসামি পক্ষের আইনজীবীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেন। সাক্ষী আব্দুল মোমেন জেরা শুরু হবার আগে আসামি পক্ষের আইনজীবী আবু ইউসুফ খলিলুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি এবং আব্দুল আলীম উভয়েই কলেবরেটর কেসে বন্দী ছিলেন। এই মামলায় আপনার জড়িত হওয়া উচিত হয়নি। তখন আইনজীবী আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান বলেন, আপনি আপানার জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, আমার কাছে গেছেন। তখন সাক্ষী বলেন, উকিল হিসেবে গেছি।
জেরার অংশ
প্রশ্ন : একাত্তর সালে ক্ষেতলাল থানার লাইন কেমন ছিল।
উত্তর : কাঁচা ছিল।
প্রশ্ন : পাকা হয়েছে কখন।
উত্তর : খেয়াল নেই।
প্রশ্ন : কোন সালে মেট্রিক পাস করেছেন।
উত্তর : ১৯৫৩ সালে পাস করেছি।
প্রশ্ন : কোন সালে চাকরিতে যোগদান করেছেন।
উত্তর : অনেক পরে খেয়াল নেই।
প্রশ্ন : চাকরি উপলক্ষে ময়মনসিংহে পোস্টিং ছিল।
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : ময়মনসিংহে থাকাকালে সার কেলেঙ্কারিতে মামলা হয়েছিল।
উত্তর : হয়েছিল। রাজনীতি করতাম বলে মামলা হয়।
আব্দুল মোমেন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী। তাকে দিয়েই আলীমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলো। সাক্ষ্য দান শেষে সাক্ষীকে জেরা করা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আবু ইউসুফ মোঃ খলিলুর রহমান। চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ২৭ আগস্ট পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন।
আব্দুল আলীমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার উপস্থিতিতেই জয়পুরহাটে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার জন্য আলীমকে অভিযুক্ত ও সাক্ষ্য শেষে তাকে শনাক্ত করেন সাক্ষী মোমেন।
৯ জুলাই তার বিরুদ্ধে ৪২ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউশন পক্ষের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ও প্রসিকিউটর কেএম সাইফুল ইসলাম। ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আলীমকে অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনাল-২। (অসমাপ্ত)

No comments

Powered by Blogger.