কালান্তরের কড়চা-প্রধানমন্ত্রীর একটি অসতর্ক উক্তি এবং তার প্রতিক্রিয়া by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

দিন পনরোর মতো লন্ডনের বাইরে ছিলাম। সে জন্য ঢাকার কোনো কাগজেই আমার নিয়মিত কলামগুলো লিখে উঠতে পারিনি। অবকাশ-বিনোদনে নয়, কিছু পেশাদারি কাজের জন্যই আজ দুবাই, কাল সিঙ্গাপুর, পরশু ঢাকা এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানির আউসবুর্গ শহরে (মিউনিকের পাশে) দুই দিন কাটিয়ে গত রবিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) লন্ডনে


ফিরেছি। আউসবুর্গে সেই শহরের কর্তৃপক্ষ ও জার্মান-বাংলাদেশ সমিতির উদ্যোগে একুশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপিত হলো। সম্ভবত ইউরোপের একটি দেশে এই প্রথম সরকারি উদ্যোগে উদ্‌যাপিত হলো একুশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।
রবিবার ভোরে লন্ডনে ফেরার জন্য মিউনিক এয়ারপোর্টে বসে আছি, তখন আমাকে বিদায় দিতে আসা জার্মানিতে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি বন্ধু বললেন, আপনি তো বেশ কদিন যাবত আকাশপথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, নিশ্চয়ই দেশের খবর রাখেন না। বললাম, রাখি না বলি না। তবে ভালোভাবে রাখার সুযোগ পাচ্ছি না। তিনি বললেন, ঢাকায় একটি জোড়া খুন হয়েছে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এক তরুণ সাংবাদিক দম্পতিকে। নাম সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি। তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে মেঘকে মাত্র বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
বলেছি, এই খবরটাও আমি জেনেছি। কেবল জানি না কেন এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটানো হলো। পুলিশি তদন্ত চলছে শুনেছি। বন্ধু বললেন, এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলেছেন, তা জানেন? বলেছি, না, তা জানি না। বন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তিনি বলেছেন, 'সরকারের দায়িত্ব কাউকে বেডরুমে পাহারা দেওয়া নয়।' বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। অনেক কষ্টে নিজের মনের ক্ষোভ চেপে রাখলেন বলে আমার ধারণা হলো।
আমিও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকেছি। ঢাকা শহরে এমন একটি নৃশংস জোড়া খুন (তা-ও আবার এক প্রতিভাবান সাংবাদিক দম্পতির) সম্পর্কে শেখ হাসিনা মুখ ফসকেও এমন কথা বলতে পারেন, তা আমার বিশ্বাস হলো না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর যে প্রকৃতই একটি মায়ের মন আছে এবং তা দেশের মানুষের দুঃখে কাঁদে, তা আমি জানি। তাহলে এমন একটি নির্দয় কথা তাঁর মুখ থেকে কিভাবে, কী পরিস্থিতিতে বেরোলো?
বন্ধুকে বললাম, আপনার এই খবরটা কি সঠিক? তাঁর সঙ্গে আসা আরো দু-তিনজন বন্ধু বললেন, খবরটা সঠিক। তাঁদের চোখে-মুখেও স্পষ্টই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। তাঁদের মধ্যে একজন, যিনি আওয়ামী সমর্থক, স্পষ্টভাবেই তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনি সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। তাঁকে আমাদের হয়ে জানাবেন কি, তিনি যেন দয়া করে এ ধরনের কথা বলা থেকে নিবৃত্ত থাকেন? তাঁর মনে রাখা উচিত, তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, বঙ্গবন্ধুরও কন্যা।
বিদেশেও শেখ হাসিনার একটি উক্তির এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়ে আমাকে নীরব থাকতে হয়েছে। মানুষ হিসেবে এবং রাজনীতিক হিসেবেও শেখ হাসিনার অনেক গুণ। কিন্তু বিনা দ্বিধায় একটি কথা বলব, তাঁর চরিত্রের একটি ত্রুটি অতিকথন প্রবণতা। এই ত্রুটি তাঁর চরিত্রের অনেক গুণ ঢেকে ফেলে। এটা আমার বিশ্বাস, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে শেখ হাসিনা যে কথাটি বলেছেন, তা তাঁর মনের কথা নয়। সাংবাদিকদের কাছে কোনো কারণে, কোনো ধরনের উস্কানিমূলক প্রশ্নের মুখে তিনি কথাটি বলেছেন কি না, তা আমি জানি না। এটি একটি বেফাঁস কথা। তবু বলব, এটি দেশের একজন প্রধানমন্ত্রী, বিশেষ করে শেখ হাসিনার মতো প্রধানমন্ত্রীর মুখে মানায় না। এই উক্তি দেশ-বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে।
বিশ্বের বহু দেশে এমন অনেক প্রাজ্ঞ, প্রবীণ, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতার উদাহরণ আছে, যাঁরা অনেক সময় বেফাঁস কথা বলতেন। ফলে অনেককে পস্তাতে হয়েছে, এমনকি অনেকের রাজনৈতিক জীবনের ইতি হয়েছে। যার প্রমাণ রয়েছে, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মতো বিশ্ববিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার জীবনেও। শেরেবাংলা ফজলুল হকের মতো তুখোড়, অভিজ্ঞ, প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা পর্যন্ত প্রায়ই বেফাঁস কথা বলতেন। সে জন্য তাঁকে একাধিকবার খেসারতও দিতে হয়েছে দারুণভাবে। শেষ বয়সে পৌঁছে তিনি নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেছিলেন এবং বলেছিলেন, �my worst enemy is my tongue�- 'আমার জিহ্বাই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় শত্রু'।
চার্চিলের কথায় আসি। ফ্যাসিস্ট হামলা থেকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা (saviour)) এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা হিসেবে স্বীকৃত ও সম্মানিত মি. চার্চিলের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিল তাঁর একটি বেফাঁস উক্তি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। মি. চার্চিল বয়োবৃদ্ধ এবং শেষবারের মতো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। হঠাৎ এক দিন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে বসলেন, 'দ্বিতীয় মহাযুুদ্ধের শেষদিকে আমি চেয়েছিলাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মিত্রপক্ষ হলেও সোভিয়েত লালফৌজ যেন বার্লিনে ঢুকতে না পারে। সে জন্য আমি আমাদের সেনাপ্রধানকে গোপনে নির্দেশ দিয়েছিলাম, পরাজিত জার্মান সৈন্যদের হাতে অস্ত্র দাও। তারা যেন সোভিয়েত সৈন্যের বার্লিন দখল করা ঠেকাতে পারে।'
চার্চিলের এই বেফাঁস উক্তিটি তখন যুদ্ধোত্তর বিশ্বে দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল এবং তাঁর নিজের ও ব্রিটেনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল। ব্রিটিশ রাজনীতিকরা এবং তাঁর নিজের কনজারভেটিভ দলও তাতে প্রমাদ গোনে। প্রথমে তাঁরা চেষ্টা করেন, চার্চিল বুড়ো বয়সের ভীমরতির দরুন এই বেফাঁস কথাটি বলেছেন বলে কথাটি ধামাচাপা দিতে। তাতে সফল না হওয়ায় চার্চিলের ওপর প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে সরে দাঁড়াতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেনের হাতে প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্বভার দিয়ে চার্চিলকে পদত্যাগ করতে হয় এবং এভাবে বিশ্বের একজন সেরা রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবনের কার্যত অবসান ঘটে।
শেখ হাসিনা আজ তিন দশকের বেশি সময় ধরে তাঁর দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীপদে অধিষ্ঠিত আছেন। দু-দুবার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হয়তো হবেন। তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটি এবং দূরদর্শিতা দুই-ই এসেছে এবং তা দেশ-বিদেশে স্বীকৃত হয়েছে। এই অবস্থায় সাগর-রুনি নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত নির্দয় উক্তিটি যে তাঁর মুখে মানায় না, এটা নিশ্চয়ই তিনি এখন উপলব্ধি করেন। এই বেফাঁস উক্তিটির জন্য তাঁর দুঃখ প্রকাশ করা উচিত এবং অবিলম্বে এই হত্যাকাণ্ডের যাতে সুরাহা হয় এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা সাজা পায় তার বিহিত-ব্যবস্থা করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া উচিত।
এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশ এখনো তদন্ত চালাচ্ছে। সুতরাং এ সম্পর্কে অনুমানমূলক বা গুজবনির্ভর কোনো আলোচনায় আমি যেতে চাই না। তবে আমার কথা, এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে 'বেডরুমে পাহারা দেওয়ার' তুলনা টানা একেবারেই বেমানান। এটি একটি নির্দয় উক্তিও। যেকোনো সরকারের দায়িত্ব নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান। তা ঘরের বেডরুমেই হোক, কিংবা প্রকাশ্য রাজপথেই হোক। সবসময় এই নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হয় তা নয়। তাই বলে সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব এড়াতে চাইলে বুঝতে হবে, সেই সরকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক অথবা অপারগ। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে অধিকাংশ রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি। তাই বলে আওয়ামী লীগের শাসনামলে একটি সম্ভাবনাময় সাংবাদিক দম্পতির জীবন এমন নৃশংসভাবে ধ্বংস করার ব্যাপারটিকে বেডরুমের হত্যাকাণ্ড আখ্যা দেওয়া শোভন নয়, সংগতও নয়। প্রধানমন্ত্রী এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত সুরাহায় কঠোর হোন এবং প্রমাণ করুন, তিনি যা অসর্তক মুহূর্তে বলেছেন, তা তাঁর মনের কথা নয়।
কেবল শেখ হাসিনা কেন, চার্চিল, নেহরু, ফজলুল হকের মতো প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ নেতাও অনেক সময় অসতর্ক মুহূর্তে অনেক বেফাঁস কথা বলতেন। কিন্তু তাঁদের সতর্ক করার জন্য তাঁদের রাজনৈতিক উপদেষ্টারা অষ্টপ্রহর সক্রিয় থাকতেন। বে অব পিগ্স্-এর ক্রাইসিসের সময় প্রেসিডেন্ট কেনেডির একটি বেফাঁস উক্তি সংশোধন করেছিলেন তাঁর প্রেস অ্যাডভাইজার সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রেস কনফারেন্স ডেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারপাশে তো এখন ডজনের বেশি উপদেষ্টা। তাঁদের মধ্যে একজনও কি বিচক্ষণ ও সাহসী রাজনৈতিক উপদেষ্টা নেই, যিনি দরকার হলে কেনেডি ও নেহরুর উপদেষ্টাদের মতো তাঁদের বসের বক্তব্য সেন্সর ও কারেকশন করতে পারেন? তাঁদের সবাই কি বেতনভাতা খাওয়ার উপদেষ্টা?
লন্ডন, ২৭ ফেব্রুয়ারি, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.