খাদ্যে বিষ ও ভেজালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড by আশরাফ-উল-আলম

ফরমালিন, কার্বাইড, ইউরিয়া সার, হাইড্রোজসহ নানা ক্ষতিকর ও রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যে ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে খাদ্যে ভেজাল দেওয়াসহ বিষ মেশানো চলছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসে। কালেভদ্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও চলে।


কিন্তু অপরাধীরা শেষ পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এর একটিই কারণ, তা হচ্ছে আইন প্রয়োগে উদাসীনতা।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে দেশের প্রচলিত আইনেই। অথচ অজ্ঞাত কারণে ওই আইনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে না। খাদ্যে ভেজালকারীদের আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কোনো নজির এ দেশে নেই। অথচ উন্নত বিশ্বে বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ওই সব দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর হার কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধের শাস্তি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবজ্জীবন, চীনে মৃত্যুদণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এসব দেশে বর্তমানে এসব কঠোর আইনেই ভেজাল মেশানোর অপরাধের বিচার হচ্ছে। পাকিস্তানেও ভেজাল খাদ্য বিক্রিকারীদের দ্বিতীয়বার অপরাধ করার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই : এ উপমহাদেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮৬০ সালে প্রণীত হয় দণ্ডবিধি। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশেও দণ্ডবিধির প্রচলন বলবৎ থাকে। দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারায় খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭২ ধারায় বিক্রির জন্য খাদ্য বা পানীয়তে ভেজাল মেশানোর দায়ে কোনো ব্যক্তিকে অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৭৩ ধারায় ক্ষতিকর খাদ্য ও পানীয় বিক্রির অপরাধেও ছয় মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে। ওষুধে ভেজাল মেশানো বা ভেজাল মেশানো ওষুধ বিক্রির জন্য দণ্ডবিধির ২৭৪ ও ২৭৫ ধারায় সর্বোচ্চ ছয় মাসের শাস্তির বিধান রয়েছে। এরই মধ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা বাড়তে থাকায় ১৯৫৯ সালে মানুষের ভোগের জন্য খাদ্য প্রস্তুত ও বিক্রি অধিকতর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশের ৬ ধারা থেকে ৩৭ ধারা পর্যন্ত খাদ্যে ভেজাল মেশানো, ভেজাল খাদ্য বিক্রি, ভেজাল খাদ্যবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বাধা দেওয়ার জন্য শাস্তির বিধান করা হয়। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশের এসব ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর আর সর্বনিম্ন শাস্তি ছয় মাস কারাদণ্ড করা হয়। একই সঙ্গে পাঁচ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। কিন্তু এই আইন কার্যকর থাকলেও খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল মেশানো বা ভেজাল মেশানো খাদ্য বিক্রির পরিমাণ আরো বাড়তে থাকে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভেজাল খাদ্য ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির হার বেড়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এ আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করলে অপরাধী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে বলে বিধান করা হয়। এ ছাড়া ক্ষতিকর প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন (যা মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর) করলে অপরাধীকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বা যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়। কিন্তু এমন আইন প্রয়োগের বা এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত এ দেশে নেই।
উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশ : খাদ্যের মান বজায় রাখাসহ নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালের ২০ জুন রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে প্রতিটি জেলায় খাদ্য আদালত গঠন এবং ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে খাদ্যের মান ও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য খাদ্য পরীক্ষক নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই রায় দেন। ওই রায় আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট আবার একটি আদেশ দিয়ে প্রশাসনকে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ওই আদেশও কার্যকর হচ্ছে না।
খুনির চেয়েও ভয়ংকর : খাদ্যে ভেজাল মেশানো এমন একটি অপরাধ, যা খুনের চেয়ে জঘন্য। এক ব্যক্তি একজন বা দুজনকে খুন করে। আর খাদ্যে ভেজাল যারা মেশায়, তারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের অনেক মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ কারণেই অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ভেজালকারীদের খুনিদের চেয়েও ভয়ংকর অপরাধী বলে মনে করেন।
বর্তমানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়। আটক করা হয় খাদ্যে ভেজাল, ফল ও শাকসবজিতে রাসায়নিক দ্রব্য, মাছে ফরমালিনসহ ভেজালকারীদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু জরিমানা করেই অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারাদণ্ড দেওয়া হলেও তা হয় নামমাত্র। দণ্ডপ্রাপ্তরা আপিল করে জামিন পেয়ে যায়। একই সঙ্গে আপিলে বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এ কারণে ভেজালকারীরা ফিরে এসে আবার একই অপরাধ করে থাকে।
জানা যায়, দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা হলেও বিচারে কী হয়, তা দেশের মানুষ জানতে পারে না। ভেজাল ওষুধ বিক্রির অপরাধে কিছু ওষুধ কম্পানির বিরুদ্ধে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মামলা হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে গেছে। এখনো দু-একটি কম্পানির বিরুদ্ধে বিচার চলছে। কিন্তু বিচারের ধীরগতির কারণে এখন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.