চরাচর-শত বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর by নীরু শামসুন্নাহার

সভ্যতার নিরন্তর বহমানতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ক্রমান্বয়ে শত বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। জাদুঘরের প্রধান কাজ হলো- নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শন। প্রবহমান সংস্কৃতির অনুশীলন, মূল্যবোধ নির্মাণ ও চিত্তবৃত্তির চর্চাকেন্দ্রও বটে।


বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর মূল কাজের পাশাপাশি জাতিকে আত্মপরিচয়ের সূত্র অনুসন্ধানে সাহায্য করার কাজটি বিভিন্ন মাধ্যমে করে চলেছে। বস্তুগত স্মৃতি-নিদর্শনগুলোর মধ্য দিয়েই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তোলার কাজটি প্রতিনিয়ত করে চলেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।
আমাদের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের নানা উপাদানের চলমান সংগ্রহ ভাণ্ডার হিসেবে জাতীয় জাদুঘরের গুরুত্ব অপরিসীম। চিন্তার এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বিশ শতকের শুরুতে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সমকালীন ইতিহাস সংরক্ষণের সময়োচিত ভাবনায় আন্দোলিত হয় কয়েকজন মহতী মানুষের চিত্ত। তাঁরা তাঁদের দূরদৃষ্টি দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।
সেই লক্ষ্যে ১৯১২ সালের ২৩ জুলাই গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের সম্মানে আয়োজিত ঢাকার নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা সভায় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যোগদান করেন। এর ফলে ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ব্রিটিশ সচিবালয়ের একটি কক্ষে (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ) কয়েকটি মূর্তি ও শিলং ক্যাবিনেট-খ্যাত মুদ্রা দিয়ে সর্বপ্রথম 'ঢাকা যাদুঘর' আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট 'ঢাকা যাদুঘর' জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাঙালির আপন ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হলো 'ঢাকা যাদুঘর' প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
'ঢাকা যাদুঘর'কে আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জাতীয় জাদুঘরকে আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে গ্যালারিতে নিদর্শন উপস্থাপনে বর্তমান সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে তিনটি কর্মসূচি ও একটি প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরকে বিশ্বমানের জাদুঘরে পরিণত করার লক্ষ্যে 'বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দুটি বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শনী স্থাপন' শীর্ষক কর্মসূচিটি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রথমটিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৭, ৩৮, ৩৯ ও ৪০ নম্বর গ্যালারিতে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ'-এর ঘটনাবলি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। এ কর্মসূচির আওতায় 'লাইট অ্যান্ড সাউন্ড' শোর মাধ্যমে ১৯৪৭-পূর্ব ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২), মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ- এই চারটি বিষয়ের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন। মহান ভাষা আন্দোলন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় জীবনের ওপর দুটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। এ ছাড়া দর্শকদের জন্য কিয়স্ক এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১০ জন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য নির্মাণ ও কাগজজাত নিদর্শনের ডিজিটাল ইমেজিং ও প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে সমকালীন ইতিহাস তুলে ধরার কাজ সম্পাদন করা হয়েছে।
নীরু শামসুন্নাহার

No comments

Powered by Blogger.