চারদিক- বীজ থেকে মহীরুহ by ড. নীরু শামসুন্নাহার

সময়ের নিরন্তর বহমানতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ক্রমান্বয়ে শত বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের যেকোনো জাদুঘরের মতোই নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনসংক্রান্ত মূল কাজগুলোর পাশাপাশি অভিন্ন মানস নির্মাণ ও চিত্তবৃত্তি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ


জাতীয় জাদুঘর বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বিশ শতকের শুরুতে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সমকালীন ইতিহাস সংরক্ষণের সময়োচিত ভাবনায় আন্দোলিত হয় কজন মহতী মানুষের মননশীল চিত্ত। তাঁরা তাঁদের দূরদৃষ্টি দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সেই লক্ষ্যে ১৯০৯ সালে ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয়। ১৯১২ সালের ২৩ জুলাই গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের সম্মানে ঢাকার নর্থব্রুক হলে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকেরা লর্ড কারমাইকেলের কাছে ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন।
সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আট মাসের মধ্যে ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা জাদুঘরের উন্নয়নকল্পে অনুদান মঞ্জুর করে। এই অনুমোদনই বর্তমান জাতীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রথম সফল সূত্রপাত। ওই বছরেরই ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ব্রিটিশ সচিবালয়ের একটি কক্ষে (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ) কয়েকটি মূর্তি ও শিলং ক্যাবিনেট খ্যাত মুদ্রা দিয়ে সর্বপ্রথম ‘ঢাকা যাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ‘ঢাকা যাদুঘর’ জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাঙালির আপন ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হলো ‘ঢাকা যাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
১৯১৪ সালের ৬ জুলাই ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮-১৯৪৭) ঢাকা যাদুঘরের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর অধ্যক্ষ নলিনীকান্ত ভট্টশালী জাদুঘর আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রচুর নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর অপরিসীম অধ্যবসায় ও মমতা দিয়ে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ১৯১৫ সালে নিমতলীর বারদুয়ারী ও দেউরীতে স্থানান্তরিত হয় জাদুঘরটি। গোটা তিরিশ মূর্তি, প্রায় তিন হাজার ২০০ মুদ্রা, গোটা দশেক তাম্রলিপি—সব মিলিয়ে হাজার চারেক নিদর্শন আর আটটি গ্যালারি ছিল নিমতলীর ‘ঢাকা যাদুঘর’-এ।
১৯১৫ সালের ৩১ মার্চ এইচ ই স্ট্যাপলটন ঢাকা যাদুঘরের প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২৫ আগস্ট ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৫৩ দিনে চার হাজার ৪৫৩ জন দর্শক জাদুঘর পরিদর্শন করে। এর মধ্যে পুরুষ দর্শক চার হাজার ৩১০, নারী দর্শক ১৪৩ জন (Annual Report of the Dacca Museum 1915-1952)। সুদীর্ঘ ৯৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক দর্শকসংখ্যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ২৩ হাজার ২৩৪ জন (২০১১-২০১২, বার্ষিক প্রতিবেদন, বা.জা.জা)।
১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা যাদুঘরকে আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
সাম্প্রতিক কালে গ্যালারি পুনর্বিন্যাস ও নিদর্শন উপস্থাপনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরকে আন্তর্জাতিক জাদুঘরের পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের গ্যালারি পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। নিয়মিত স্কুল শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় শিক্ষার্থীদের গ্যালারি পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার আগে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও নিদর্শন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হচ্ছে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরকে বিশ্বমানের জাদুঘরে পরিণত করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ’-এর ঘটনাবলি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সত্যনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করার দুটি কর্মসূচি ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ শোর মাধ্যমে ১৯৪৭-পূর্ব ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২), মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ—এই চারটি বিষয়ের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন; জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মময় জীবন নিয়ে দুটি প্রামাণ্যচিত্র; কাগজজাত নিদর্শনের ডিজিটাল ইমেজ ও কিয়স্কের মাধ্যমে সমকালীন ইতিহাস তুলে ধরা। আশা করা যায়, এ বছরই বাংলাদেশের অতীত, দূর অতীত ও সমকালীন ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনাপঞ্জি দর্শকের মাঝে মাল্টি মিডিয়া প্রজেকশনের মাধ্যমে উন্মোচিত হবে।
‘ডিজিটালাইজেশন’ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও চারটি শাখা জাদুঘরের প্রায় এক লাখ নিদর্শনের Object ID বাস্তবায়নের কর্মসূচির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি জাদুঘরকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে তোলা এবং একটি আন্তর্জাতিক মানের ‘স্যুভেনির শপ’ নির্মাণের বিষয়েও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শত বছর আগে একটি মহৎ আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল, এখন সেটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের তরুণেরা জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত ইতিহাসের প্রত্যক্ষ নিদর্শন সরাসরি দেখে, উপলব্ধি করে ইতিহাসের গভীরতর শেকড় থেকে টেনে নেবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রাণরস এবং ইতিহাসের সঠিক চেতনায় নিজেকে জারিত করে গড়ে তুলবে সোনার বাংলাদেশ। শতবর্ষী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ইতিহাসসচেতন মানবকল্যাণমুখী জনগোষ্ঠী তৈরিতে গঠনমূলক ভূমিকা পালনে আরও বেশি প্রত্যয়ী।
ড. নীরু শামসুন্নাহার
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর
niru.terracotta@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.