কিংবদন্তি তো হয়েই গেছেন বোল্ট! by উৎপল শুভ্র

কিংবদন্তি হতে চান। হয়েই তো গেলেন। পুরো বিশ্বকে থমকে দেওয়া গত পরশু রাতের ১০ সেকেন্ডে অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেললেন উসাইন বোল্ট। আবার সেই বাঁধভাঙা উদ্যাপন। বিচিত্র মুখভঙ্গি। কখনো বা একটু নাচ। মাঠে চক্কর দিতে দিতে একটু পর পর দাঁড়িয়ে খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সেই উদ্যাপন—কাল্পনিক ধনুকে কাল্পনিক তির ছোড়া। ৮০ হাজার দর্শকের ‘উসাইন’ ‘উসাইন’ চিৎকারে প্রকম্পিত অলিম্পিক স্টেডিয়াম।


বেইজিং অলিম্পিকে এই দৃশ্যের সঙ্গে বিশ্বের প্রথম পরিচয়। লন্ডনে এর পুনরাভিনয়ে একটু পার্থক্য থাকল। বেইজিংয়ে প্রায় ২০ মিটার বাকি থাকতেই বুক চাপড়ে, দুই হাত ছড়িয়ে উদ্যাপন শুরু করে দিয়েছিলেন। শুধু অলিম্পিকে কেন, কোথায় কখনো ১০০ মিটারে এমন দৃশ্য কেউ দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন না। এখানে বোল্টকে সর্বস্ব নিংড়ে দিতে হলো।
বেইজিংয়ে ৯.৬৯ সেকেন্ড শুধু অলিম্পিক রেকর্ডই ছিল না, ছিল নতুন বিশ্ব রেকর্ডও। এখানে ৯.৬৩ সেকেন্ডে শুধু অলিম্পিক রেকর্ডটাই হলো।
৯.৫৮ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ডটাও বোল্টেরই। ১০০ মিটারে ইতিহাসের দ্রুততম তিনটি টাইমিংই এখন তাঁর। সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার হিসেবে তো নাম লেখাই হয়ে গেছে। কিংবদন্তি বললে সমস্যা কী! অলিম্পিকে ১০০ মিটারের সোনা ধরে রাখার কীর্তিতে একজন সঙ্গী আছেন। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেসের পর ১৯৮৮ সিউলেও ১০০ মিটারের সোনা জিতেছেন কার্ল লুইস। তবে একটা জায়গায় বোল্ট এগিয়ে। দুজনেরই পরপর দুটি সোনা, কিন্তু দুই অলিম্পিকে সবার আগে ১০০ মিটারের সমাপ্তিরেখা পেরোনোর আনন্দ শুধু বোল্টেরই জানা। সিউলে লুইসের আগে ছিলেন বেন জনসন, যিনি পরে ডোপপাপী প্রমাণিত হওয়ায় রুপালি থেকে সোনালি হয়ে যায় লুইসের পদকের রং। কিংবদন্তি তো তা হলে হয়েই গেছেন উসাইন বোল্ট!
চাইলে দাবি করতেই পারতেন। কিন্তু বোল্ট তা করছেন না। কিংবদন্তি হতে নাকি আরেকটা ধাপ পেরোনো বাকি। ২০০ মিটারের সোনাটাও ধরে রাখতে পারলে তখন বলবেন, হ্যাঁ, এবার আমাকে কিংবদন্তি বলতে পারেন। ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চির বিশাল শরীরের ওই লোকটার যেন ট্র্যাকের সব রেকর্ড গুঁড়িয়ে দিতেই আবির্ভাব। অলিম্পিক ইতিহাসে কারও ২০০ মিটারে দুটি সোনা নেই। বোল্ট কি পারবেন? ১০০ মিটারে আবারও পুরোনো রূপে দেখা দেওয়ার পর প্রশ্নটা খুব খেলো শোনাচ্ছে।
বেইজিংয়ের চেয়ে কাজটা অনেক কঠিন ছিল এখানে। বেইজিংয়ে বোল্ট উদীয়মান তারকা, আর এখানে তিনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাথলেট। গত বছর খানেক আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাসের ঘরে বাসা বেঁধেছিল সংশয়ের ঘুণপোকাও। ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট হারানোর যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে, চোট-আঘাতের সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎও। জ্যামাইকান ট্রায়ালে ১০০ ও ২০০ মিটার দুটিতেই ইয়োহান ব্লেকের কাছে হেরে গেলেন। হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে সরে দাঁড়ালেন অলিম্পিক-পূর্ব শেষ মিটটা থেকে। আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হচ্ছিল প্রশ্নটা, ‘বোল্ট-যুগ’ কি তা হলে শেষ হতে চলেছে? এই প্রশ্নচিহ্ন মাথায় নিয়ে, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার দায় নিয়ে তো এই প্রথম দৌড়ালেন বোল্ট।
গত শনিবার প্রথম রাউন্ডের বোল্টকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কী চাপে আছেন! চার বছর ধরে বোল্টকে যাঁরা দেখে আসছেন, একটা ব্যাপার তাঁদের সবারই জানা। যখন নির্ভার থাকেন, দৌড় শুরুর আগে দর্শকদের সঙ্গে মজা করেন, তখনই সেরা রূপে দেখা যায় ‘জ্যামাইকান বিদ্যুৎ’কে। প্রথম রাউন্ডে বোল্টের মুখে হাসি নেই, স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি নেই। গত পরশু ফাইনালের ঘণ্টা দুয়েক আগের সেমিফাইনালে প্রথম দেখা দিলেন স্বরূপে। নাম ঘোষণার পর নানা অঙ্গভঙ্গি করলেন, হাওয়ার সঙ্গে বক্সিং করলেন কয়েকবার। শেষ দিকে আয়েশি ভঙ্গিতে দৌড়েও সময় নিলেন মাত্র ৯.৮৭ সেকেন্ড। প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে বার্তাটা তখনই পৌঁছে গিয়েছিল।
অলিম্পিকের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ১০০ মিটার। সেটির চাক্ষুষ সাক্ষী হতে টিকিটের জন্য আবেদন করেছিল ২০ লাখ লোক। তাদের মধ্যে ভাগ্যবান ৮০ হাজার দর্শক বাকি জীবন গল্প করার রসদ পেয়ে গেল। ফাইনালের আটজনের মধ্যে সাতজনই দৌড়েছেন ১০ সেকেন্ডের কমে। আসাফা পাওয়েল চোট না পেলে সংখ্যাটা হয়তো আটে আটই হতো। সাতজন ও বেইজিংয়ে ১০ সেকেন্ডের কমে দৌড়ানো ছয়জনকে ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড। ৯.৭৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয় হয়েছেন বোল্টের জ্যামাইকান সতীর্থ ইয়োহান ব্লেক। এথেন্সের সোনাজয়ী জাস্টিন গ্যাটলিন তৃতীয় (৯.৭৯)। ব্লেকের টাইমিং তাঁর ব্যক্তিগত সেরা। গ্যাটলিন ও তাঁর পেছনের চারজন ছাড়িয়ে গেছেন তাঁদের আগের সেরা টাইমিংকেও। সর্বকালের সেরা ১০০ মিটার না বলে আর উপায় কি!
এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার কে—এই তর্কের দিন বোধ হয় ফুরোল!

No comments

Powered by Blogger.