সাক্ষ্যে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণ ছিল লোক দেখানো

পিলখানা হত্যা মামলায় গতকাল সোমবার সাক্ষ্য দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (বর্তমানে মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) নূর মোহাম্মদ। সাক্ষ্যে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে পিলখানায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জওয়ানদের অস্ত্র সমর্পণ ছিল লোক দেখানো।


জওয়ানদের দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা ছিলেন নেতৃত্বহীন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এক আত্মীয়ও তখন পিলখানায় ঢুকেছিলেন।
রাজধানীর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী মহানগর দায়রা জজ আদালতে নূর মোহাম্মদ এই সাক্ষ্য দেন। পরে আসামিপক্ষের তিন আইনজীবী আমিনুল ইসলাম, শামীম সরদার ও ফারুক আহমেদ তাঁকে জেরা করেন।
অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আকতারুজ্জামান এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে গত ২ জুলাই সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মো. জয়নুল আবেদীন ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদকে সমন জারি করেন। মিয়া মো. জয়নুল আবেদীন ১ আগস্ট সাক্ষ্য দেন। নূর মোহাম্মদ সাক্ষ্য দিতে মরক্কো থেকে ঢাকায় এসেছেন।
বিচারক জহুরুল হক এজলাসে আসার পর সকাল সাড়ে নয়টায় কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগেই কারাগারে থাকা মামলার আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। কার্যক্রম শুরুর পর সাক্ষ্যে সাবেক আইজিপি বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সদর দপ্তরে কাজ করার সময় র‌্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার তাঁকে জানান, পিলখানায় গন্ডগোল হচ্ছে। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। তিনি ডিএমপি কমিশনার, র‌্যাবের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল ১০টার দিকে ডিএমপি কমিশনার, র‌্যাবের মহাপরিচালক, এপিবিএনের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছালে তিনি তাঁদের দ্রুত পুলিশ মোতায়েন করতে বলেন। এরপর পিলখানার চারপাশে র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক কথা হওয়ার উল্লেখ করে নূর মোহাম্মদ বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সরাসরি খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং তিন বাহিনীর প্রধানদেরসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম বিডিআরের সঙ্গে আলোচনার জন্য যোগাযোগ করছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি পুলিশ নিয়ন্ত্রণকক্ষে যান।
সাবেক আইজিপি বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটার দিকে তিনি মৌখিক নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন সরকারি বাসভবন যমুনায় যান। এ সময় নানক ও মির্জা আজম আলোচনার জন্য ১২-১৪ জন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে যমুনায় আসেন। তাঁদের মধ্যে ডিএডি তৌহিদ, নাছির, জলিল, রহিম, সিপাহি সেলিম রেজা ও মনিরকে দেখেন। সন্ধ্যার দিকে তিনি পিলখানায় যান। সেখানে অবস্থানকালে রাত ১২টার দিকে জওয়ানরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। পরে রাত একটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজনকে নিয়ে তিনি পিলখানার ভেতরে যান। তিনি বলেন, জওয়ানরা তাঁদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যান। পাঁচ-সাতজন জওয়ান বক্তৃতায় বলেন, দাবি না মানলে তাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। জওয়ানরা দরবার হলে তাঁদের যেতে দেননি, টালবাহানা করে সময় নষ্ট করছিলেন। জওয়ানরা সশস্ত্র ছিলেন বলে চাপ দেওয়া যাচ্ছিল না।
নূর মোহাম্মদ বলেন, তাঁর জামাতা ক্যাপ্টেন মাযহার বিডিআরের মহাপরিচালকের এডিসি ছিলেন। তিনি মেয়ের খবর নিতে কর্মকর্তাদের মেসে যান। পরে আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁর মেয়েসহ কয়েকজনকে বের করে আনেন। ভোর চারটার দিকে তাঁরা বের হয়ে আসেন। পরে জামাতার মৃতদেহ পান নবাবগঞ্জ পার্কের নর্দমা থেকে।
পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা নূর মোহাম্মদকে জেরা করেন। একজন আইনজীবী প্রশ্ন করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে কী ধরনের নির্দেশ দিয়েছিলেন? জবাবে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। এর পরই পিলখানার চারপাশে র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়।’
তিনি কোনো অপারেশন চালাতে বলেছিলেন—এর জবাবে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।’ সেখানে কি পুলিশ কোনো অপারেশন চালিয়েছিল—এর জবাবে তিনি বলেন, ‘না, অপারেশন চালানো হয়নি।’
আপনার জামাতা ক্যাপ্টেন মাযহার কখন ফোন করেছিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ১০টার মধ্যে দুবার কথা হয়েছে।’ এ সময় কি শাকিল আহমেদ বেঁচে ছিলেন—এর জবাবে বলেন, ‘হ্যাঁ, সে বলেছিল ডিজি বেঁচে আছেন।’
জামাতা আপনাকে কী বলেছিলেন—আইনজীবীর এ প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বলেন, ‘মাযহার জানিয়েছিল, মহাপরিচালককে একজন গুলি করতে চেয়েছিল।’ আপনার জামাতা কি কোনো সাহায্য চেয়েছিলেন—এর জবাবে তিনি বলেন, ‘না, চায়নি।’ মেয়ের সঙ্গে আপনার কতবার কথা হয়েছিল—এর জবাবে বলেন, ‘বহুবার।’ ভেতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সে কী বলেছিল—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে বলেছে, শুধু গোলাগুলি হচ্ছে।’
আপনি তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভেতরে গিয়েছিলেন। ওই সময় সরকারি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা সরকারি কোনো কর্মকর্তা না হওয়া সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগনে সারোয়ার মন্ত্রীর সঙ্গে পিলখানার ভেতরে গিয়েছিলেন—আইনজীবীর এ কথায় নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘হ্যাঁ, ছিলেন।’ সারোয়ার কি রাজনীতি করেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা তাঁর জানা নেই।
যমুনায় যাওয়ার পর আপনি কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পিলখানায় অভিযানের অনুমতি চেয়েছিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক আইজিপি বলেন, না, চাননি। সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড পিলখানার চারদিকে মোতায়েন করা হয়েছিল, জানেন—এর জবাবে বলেন, ‘মনে নেই।’
পিলখানায় মেয়ে ও জামাতা থাকার কারণে আপনি একটু বেশি তৎপর ছিলেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে দেখা হচ্ছিল। পিলখানার চারদিকে লোকজনকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছিল, জানেন—এর জবাবে বলেন, জানেন।
মাইকিংয়ের সময় বাইরের কিছু লোক পিলখানায় ঢুকেছিল, জানেন—এ প্রশ্নে সাবেক আইজি বলেন, এটা সত্য নয়। বাইরের লোকই সেনা কর্মকর্তাদের হতাহত করেছে—আইনজীবীর এ বক্তব্যও সত্য নয় বলে তিনি জানান।
আপনি ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ, এ কারণেই কি আপনাকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে—এ প্রশ্নের জবাবে নূর মোহাম্মদ বলেন, স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি বিদেশে নিয়োগ পেয়েছেন।
নূর মোহাম্মদের পর সাক্ষ্য দেন ঢাকা মেডিকেলের ডিএনএ পরীক্ষাগারের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আহমেদ ফেরদৌস ও ম্যাজিস্ট্রেট শামীমা পারভীন।
বেলা সোয়া একটার দিকে মামলার কার্যক্রম বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
সাক্ষ্য শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, ওই সময় জওয়ানদের দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা নেতৃত্বহীন। তাঁরা জানিয়ে দেন, দাবি না মানা পর্যন্ত অস্ত্র সমর্পণ করবেন না। পরে তাঁদের বোঝানো হয়। কিন্তু তাঁরা কোনোভাবেই মানতে রাজি হননি।
এর কিছু পরই জওয়ানরা কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওটা ছিল লোক দেখানো অস্ত্র সমর্পণ।’

No comments

Powered by Blogger.