কালের পুরাণ- উল্টো রথে নির্বাচন কমিশন by সোহরাব হাসান

কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ফাইনাল দূরে থাকুক, এখনো কোনো বাছাই পরীক্ষায়ই অবতীর্ণ হয়নি। তাই নির্বাচন কমিশন পাস করেছে বা ফেল করেছে, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে গদিনশিন হওয়ার পর গত ছয় মাসে কমিশনের কাজকর্ম এবং কমিশনারদের কথাবার্তা মানুষকে দারুণভাবে হতাশ


করেছে। তাঁরা দেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় ও নির্জীব করে রেখেছেন। অথচ আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বলা যায়, ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি দৃষ্টি এই নির্বাচন কমিশনের প্রতি।
বর্তমান কমিশন যখন দায়িত্ব নেয়, তখন নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ তিন বছর পার হয়েছে এবং আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতির সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছিল এবং তা চলবে আগামী নির্বাচন তক। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও তাঁর তিন সহযোগী মনে হচ্ছে, তাঁরা ভিন্ন গ্রহ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে দেশব্যাপী যে আলোড়ন-বিলোড়ন, এর কিছুই তাঁদের স্পর্শ করছে না। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, বাঁশিতে একটি হুইসেল দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন।
বাংলাদেশে সরকারপ্রধানের পদটির চেয়ে সিইসির পদটি কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। আমাদের সরকারপ্রধানেরা যত অনাচারই করুন না কেন, জনগণের ভোট নিয়ে পরের বার নিষ্কলুষ হয়ে যান। কিন্তু নির্বাচন কমিশনারদের সেই সুযোগ নেই। কারও চরিত্রে একবার কালিমা পড়লে তা আর ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়েও মোছা যায় না। বিচারপতি মাসউদ, বিচারপতি সাদেক ও বিচারপতি আজিজ তাঁর জ্বলন্ত সাক্ষী।
অনেকেই বলবেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একক সুপারিশে রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হননি সিইসি বা কমিশনাররা। এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে যাঁদের নাম প্রস্তাব করেছে, তাঁদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি চারজনকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু কথায় বলে, বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।
কমিশন কীভাবে হয়েছে, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিগত কমিশনের মতো এই কমিশনও গঠিত হয়েছে একজন সাবেক আমলার নেতৃত্বে। সিইসি হিসেবে বিচারপতিদের চেয়ে আমলারা যে ভালো করেছেন, তার প্রমাণ এ টি এম শামসুল হুদা, মোহাম্মদ আবু হেনা ও এম এ সাঈদ। শামসুল হুদা ও আবু হেনাকে বিএনপি মেনে নেয়নি, এম এ সাঈদকে আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করেছে, যদিও তিনি তাদেরই নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। রাজনীতিকদের চরিত্র হলো, আমার পক্ষে গেলে সাত খুন মাফ আর বিপক্ষে গেলে সাধুও বদমাশ হয়ে যায়।
একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যে যৌথ নেতৃত্ব এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন, তা শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেখিয়ে দিয়েছে। এমনকি কমিশন বিভক্ত বিএনপির একাংশকে ছাড়পত্র দিয়ে যে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছিল, তার দায়ও তিনজন স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এর আগে যত নির্বাচন কমিশন ছিল, সিইসি ছাড়া অন্য কারও উপস্থিতি টের পাওয়া যেত না। কিন্তু শামসুল হুদা সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন। এ কথার অর্থ এই নয় যে তৎকালীন কমিশনে কোনো মতবিরোধ ছিল না। অবশ্যই ছিল। তাঁরা চেষ্টা করেছেন সেই মতবিরোধ কাটিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে। প্রতিষ্ঠানের মূল কথাই হলো যৌথ নেতৃত্ব। তা সিইসির ক্ষেত্রে যেমন, দেশের প্রধান নির্বাহীর বেলায়ও প্রযোজ্য। প্রধানমন্ত্রীই যদি সব সিদ্ধান্ত এককভাবে নেবেন, তাহলে এত সব মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কী প্রয়োজন?
শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন জাতির এক ক্রান্তিকালে কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করেনি, তারা চারটি সিটি করপোরেশন ও বহু পৌরসভার নির্বাচন সমপন্ন করেছিল, যা নিয়ে তেমন বিতর্ক হয়নি। আর দুই দশক পর দেশে যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তার একক কৃতিত্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনেরই। এর পাশাপাশি তারা নির্বাচনী ব্যবস্থায়ও তারা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বলব না, তবে সূচনাটি করে গেছে।
এ ছাড়া যে কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী দল ও সরকারও করতে পারেনি, তা বিগত নির্বাচন কমিশন করেছিল। তারা সংবিধানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ—এই যুক্তিতে জামায়াতে ইসলামীকে গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করিয়েছিল, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নামের দলটিও নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পেলে তাদের নির্বাচনী আইন সংস্কারে আরও যেসব প্রস্তাব রেখেছিল, তার বাস্তবায়ন কঠিন হতো না। দুর্ভাগ্য যে, আমাদের স্বার্থান্ধ রাজনীতি তা করতে দেয়নি। নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় বিএনপির কাছে সব প্রস্তাবই ‘গণবিরোধী’ ও ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ মনে হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ যেহেতু জিতেই গেছে, তাই তাদের নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
তৎকালীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইনে কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল। তারা সব রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছিল। তৃণমূল থেকে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। দলীয় কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্যের বিধান পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়েছিল। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের নিয়মিত সম্মেলন করা এবং দলে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। যে দেশে মন্ত্রী, সাংসদ ও আমলারা নিজেদের আয় ও সম্পত্তির হিসাবই গোপন রাখতে সদা সচেষ্ট থাকেন, সে দেশে রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়ার আইন করা সাহসী পদক্ষেপই বটে।
শুরুতে বিএনপির নেতারা বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করলেও এর অধীনে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। এটি কাজী রকিব ও তাঁর সহযোগীদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারত। কিন্তু কমিশন যে সময়মতো নির্বাচনই করতে পারল না, সেই ব্যর্থতার দায় কে নেবে? এখন বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে চলে গেছে বলে তারা অজুহাত খাড়া করতে পারে। আদালত বলেছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও ওয়ার্ডের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করেই নির্বাচন করতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে যে ওয়ার্ডের সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হয়, এই সাধারণ কান্ডজ্ঞান যাদের নেই, তারা কী করে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করবেন?
এখন অনেকেই সন্দেহ করছেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতেই কি ঢাকা সিটির নির্বাচনের বিষয়টি আদালতের হাতে তুলে দিয়েছেন? তিন মাসের স্থগিতাদেশ ছয় মাসে প্রলম্বিত হয়েছে। এর পরও নির্বাচনের ব্যাপারে কমিশনের প্রস্তুতি আছে বলে মনে হয় না। থাকলে তারা ঢাকা সিটির ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজটি অক্টোবরে নিয়ে যেত না।
সামনে চারটি সিটি করপোরেশন, নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন এবং অনেকগুলো পৌরসভা নির্বাচন। এরপর প্রায় জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে উপজেলা নির্বাচন করতে হবে। এসব ব্যাপারে কী প্রস্তুতি আছে কমিশনের?
সিইসি বলেছেন, আপাতত রোডম্যাপের কথা ভাবছেন না। কবে ভাববেন? বিএনপি ইতিমধ্যে গাজীপুর-৪ আসনে উপনির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনেও যদি তারা একই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তখন কমিশনের কী করার থাকবে? এ কারণেই রোডম্যাপের বিষয়টি সামনে এসেছে। ইসির মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো জনগণের আস্থা। আইন সহজে বদলানো গেলেও আস্থা পুনরুদ্ধার খুবই কঠিন কাজ। সাবেক সিইসি এম এ আজিজ যে ২০০৭ সালের নির্বাচনটি করতে পারেননি, তাঁর প্রধান কারণ জনগণ তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের রুটিনকাজ ছাড়াও দৃশ্যগ্রাহ্য তৎপরতা চোখে পড়েনি। অথচ তাদের সামনে অনেক কাজ। অনেকগুলো নির্বাচন। ২৫ জুলাই প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আগামী বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য আগামী জুনের আগেই ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। অবশ্য আগের কমিশন আইন সংশোধনের জন্য সরকারে কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। ওই প্রস্তাবের ওপর সরকার বর্তমান কমিশনের মতামত চেয়ে নথি গত মার্চ মাচে ফেরত পাঠায়। বর্তমান কমিশন এখন পর্যন্ত পর্যালোচনার কাজ শেষ করতে পারেনি। তবে নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার ও বিভাগের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য আগের কমিশন প্রস্তাব করেছিল, বর্তমান কমিশন তা বাদ দেবে বলে সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বর্তমানেই নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী আছে। (২৫ জুলাই, প্রথম আলো)
যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-নেতারাও নির্বাচনের সময় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, সেখানে সিইসির এই বক্তব্য দেশবাসীর কাছে কী বার্তা দেবে? তারা কি তাঁকে পোপের চেয়ে বেশি ধার্মিক বলে মনে করবেন না? মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই কমিশন সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন করতে পারবে কি না? কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ ও তাঁর তিন সহযোগী এখনো এমন কিছু করে দেখাতে পারেননি, যাতে মানুষ তাঁদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন। অন্তত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়ে তাঁরা বাছাই পরীক্ষার টেবিলে বসতে পারতেন।
আমরা প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের অনেক আগে নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রবল বিতর্ক লক্ষ করি। ২০০৭ সালের জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ও লড়াই অক্টোবরে দৃশ্যমান হলেও নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় দুই বছর আগে থেকেই। এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন সেই নির্বাচন কমিশন নিজেদের সংশোধন না করে ভুয়া ভোটার তালিকা দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। একতরফা নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সফল হয়নি।
কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ কোন পথে হাঁটবেন—এম এ আজিজ, না এ টি এম শামসুল হুদার?
শামসুল হুদার পথ কঠিন হলেও গন্তব্যে পৌঁছা অসম্ভব নয়। আর এম এ আজিজের পথ যেমন পিচ্ছিল তেমনি গন্তব্যহীন।
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.