পিস্টনের উল্লাস by জাহিদা উর্মি

বারান্দার এক কোনায় দেয়ালে ঠেকনা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে মিথিলার আজকাল নেশা হয়ে গেছে। অন্য কোন বিশেষ কারণ নেই। এখানটায় বসে সিগারেট খাওয়া আর যত সব আউলাঝাউলা চিন্তা করা তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শীতের শুরুর বিকেলটা কেমন যেন একাকিত্বে ভরা।


এখন যৌবন আর তাই একাকিত্বের বোধ বেশি বেশি টের পায় মিথিলা। একা একা থাকা মিথিলার ভাল লাগে। নিজে নিজেই কবিতা আওড়ায়, ‘আমি আমারই রক্তে করি আমার অহঙ্কার বপন, আর সেই থেকে অঙ্কুরিত হয় আমার মাধুর্যের সাধন।’ আবার নিজেই হাসে। এ যেন এক পাগলামির খেলা। মিথিলা চিন্তা করে, আচ্ছা আমি কি আমার বাবা-মার ভালবাসার ফসল? নাকি অন্য কিছু?


মনে হয় একবার মাকে জিজ্ঞাসা করে, পর মুহূর্তেই ভাবে-ওই সরল মহিলাটা এর উত্তর জানে না, নিশ্চিত। কি লাভ? এত বোধ থাকলে কি আর সে এমন লোকের সংসার করে! যৌবনে মহিলা সুন্দরী ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এখন তার ছিটেফোঁটা বোঝা যায়। এখন শুধু শরীরের সব খাঁজ মাংসে পরিপূর্ণ। মিথিলার মনে হয় বাবার যে আচরণ মিথিলার সঙ্গে তাতে মনে হয় না মিথিলা তাদের ভালবাসার ফসল। অনিলা বড় বোন, সে হলে হতে পারে কিন্তু তাতেও সন্দেহ আছে মিথিলার। কারণ অনিলাই একমাত্র রোজগার করে সেটাই কারণ কিনা! শাকিলা মেজ, হয়ত অভ্যাসের সন্তান সে। ভাইটা এত ছোট যে, মাঝেমধ্যে লজ্জা লাগে। মনে হয় বাবা-মার হঠাৎ ভীমরতির সে।
মিথিলার ইচ্ছা হয়, একসঙ্গে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে এক বসাতে। কপাল! সবই কপাল। পয়সার অভাব। বড় বোন অনিলা হাতখরচ দিলেই তার চলে, নইলে তার আর কি ক্ষমতা। বাবার কাছে একসঙ্গে ৫০০ টাকা চাইবার মতো সাহস কিংবা মনোবৃত্তি হয় না। আগাগোড়াই বাবার সঙ্গে একটা অনির্দিষ্ট লাইন টেনে রেখেছে মিথিলা। যা আবদার মা আর বড় বোনটার কাছে করে, তাও খুব সামান্য। এই যুগেও মিথিলার কোন মুঠোফোন নেই। অনিলার চলনবলন কেমন বদলে গেছে বুঝতে পারে মিথিলা। তিন বছর আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বিশ হাজার টাকার চাকরি নেয়। তিন বছরে বেতন বেড়ে এখন হয়েছে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। কর্মজীবনে খুব ভাল গতিতে এগোচ্ছে বোনটা। রাত করে বাসায় ফেরে। বাড়িতে টাকা দেয়া ছাড়া কোন খবর রাখে না, কিংবা রাখতেও ওর মন চায় না। শাকিলা এইচএসসি পরীক্ষার পর চাচাত ভাইয়ের সঙ্গে ভেগে গিয়ে বিয়ে করে। একটা বাচ্চা পয়দার পর বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। বাচ্চাটা বোনাসসহ ফেরত আসে নির্ধারিত আশ্রয়ে। সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘোরাফেরা ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই। একটা বাচ্চা যে ওর পেট থেকে বের হয়েছে সে সেটা ভুলে গেছে বলেই মিথিলার মনে হয়। বাচ্চাটা বড় হচ্ছে রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কোন পশু-পাখির বাচ্চার মতো। মা যখন একটু করুণা করে কিংবা মিথিলা যদি কখনও একটু আদর করে কাছে নেয়, সেটুকুই এই মাসুমের পাওয়া। মা তার মোটা শরীর নিয়ে সংসারের নানান ঝামেলার পর তার শেষ বয়সের ছেলের যতেœর পর একটু দয়াধর্ম করে শাকিলার ছেলের ওপর। মিথিলার মনে হয়, পৃথিবীটাকে সার্ফ এক্সেল দিয়ে একবার ধুয়ে দেয়া উচিত। অথবা এত রং-বেরঙের মসলা মাখিয়ে ওদের মনের মাঝে কিছুটা উৎকৃষ্টমানের স্বাদ জন্মানো যায় যদি। হায়রে রঙের দুনিয়া! যে বারান্দায় মিথিলা রোজ বসে থাকে সেখান থেকে কোন সুন্দর দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয় না। গলির মধ্যে পাঁচতলার তিন তলায় থাকে। আশপাশের বখাটে রোমিও আর চারপাশের বিল্ডিংয়ে শুকাতে দেয়া নানান রঙের কাপড় ঝোলানো থাকে। মাঝে মধ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ শোনা যায়, তাও পুরা বাড়িটায় এই কোনাটুকুই মিথিলার নিজের মনে হয়। অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পর মাত্র দশ দিন ক্লাস করেছে মিথিলা। প্রায়ই মনের মধ্যে কষ্ট হয়-এতটা সময় পার হলো অথচ আজ অবধি কেউ তাকে প্রেম নিবেদন করল না; যা করেছে তা প্রেম নয়, অন্য কিছু। মিথিলা দেখতে মোটেও ভাল নয়, কিন্তু শরীরের গঠন খুবই সুন্দর। আর তাই পুরুষদের কাছ থেকে প্রেম ছাড়া বাকি সব কিছুর নিবেদন পেয়েছে। ঘেন্না লাগে মিথিলার পৃথিবীটার ওপর। আর বাবা-মার ওপর! কেন জন্ম দিয়েছিল মিথিলাকে? বড় দুই বোন দেখতে সুন্দর।
অনিলার সঙ্গে বাবার খুব ভাব, কিন্তু অনিলা বাবাকে মন থেকে কতটা পছন্দ করে সেটা সে বোঝে না। অনিলা উপার্জনের বেশিরভাগ টাকাই বাবার হাতে তুলে দেয়। মিথিলার বিবেক অনুযায়ী তার বাবার এখন অনিলার বিয়ের কথা চিন্তা করা উচিত। কিন্তু বাবা ঘুণাক্ষরেও সে কথা মুখে আনে না। শাকিলা কিছু করে না, কিন্তু তার সব খরচ চলে যায়। প্রত্যেকটা শখও মোটামুটি পূরণ হয়। বারান্দায় বসলেই পরিবারটার অসমতা দারুণভাবে পোড়ায় মিথিলাকে। তখন সিগারেটের তৃষ্ণা বেড়ে যায়। ছোট ভাইটা স্বাভাবিক নয়। সব কিছু অন্য, বাচ্চাদের মতো হলেও কোথায় যেন একটা গরমিল আছে। কিন্তু এখনও সে নিশ্চিত নয়। এ সব বিষয় পরিবারের কার সঙ্গে আলাপ করবে? অনিলা ছাড়া তেমন কারও সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে না সে। অনিলার সময়ের অভাব। মিথিলা দীর্ঘশ্বাসটাকে নিজের ভেতরেই কবর দেয়। সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে দেখে ঘরের বাইরের ছেঁড়া শোফাটায় শাকিলার ছেলেটা এক পা ঝুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। মা আর বাবা দরজা বন্ধ করে তাদের ছেলেটাকে নিয়ে ঘুম দিয়েছে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মিথিলার চোখে পানি এসে গেল। বাচ্চাটার সর্দি লেগেছে। নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে নাকেই শুকিয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিজ বিছানায় শুইয়ে দিল। মন চাচ্ছে শাকিলা বাসায় এলে ওর গালে কষে একটা চড় লাগাবে। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে মিথিলা ভাবে-এই মাসুম বাচ্চাটার কি দোষ? শাকিলা কেন ছেলেটার প্রতি নজর দেয় না? যদি বাচ্চাটার জন্য ওর কোন অনুভূতি না থাকে তা হলে জন্ম কেন দিয়েছিল? নাকি ওর চামার স্বামীর প্রতিশোধ বাচ্চাটার ওপর তুলছে? অথচ বাচ্চাটার কোন দোষ মিথিলা খুঁজে পায় না। বাচ্চাটা যে এই বাড়িতে থাকে ওকে দেখেই মনে পড়ে সবার- সাড়াশব্দহীন লক্ষ্মী একটা বাচ্চা।
মিথিলাদের বাসার সামনের বিল্ডিংটা বেশ সুন্দর, ভাড়াও বেশি। ওর বসার জায়গার সামনের ফ্ল্যাটটা এতদিন খালি ছিল। আজ বারান্দায় বসার পর মনে হলো কোন লোক উঠছে ফ্ল্যাটটাতে, মালপত্র আসছে। মালপত্র দেখেই বোঝা যায় ভাল অবস্থা এবং রুচিসম্পন্ন। ভালই লাগল, সঙ্গে একটু কষ্টও হলো- সিগারেটের সুখটানের ব্যাঘাত হতে পারে। পরক্ষণেই ভাবল, কার বাপের কি! আমি কি ভয় পাই? মা, অনিলা, শাকিলা সবাই জানে। শুধু জানে না বাবা। জানবে কোথা থেকে, দুনিয়াতে নিজেকে ছাড়া আর কিছু কি ভাবার অবকাশ তার আছে? এত অভাবের সংসারেও তো সে কেমন সুখী সুখী মুখ নিয়ে বসে থাকে। তার মেজাজ বা মুখের ভাবের তখনই ব্যাঘাত ঘটে যখন সে বাজার থেকে ফিরে আসে। বাজার থেকে ফিরেই ভাবটা এমন করে যেন সব বাজার মা একাই খায়, কিংবা সবাই কেন খাওয়া শিখল! ঘণ্টাখানেক মনে কচ কচ করার পর তার মুখের সুখবোধ ফিরে আসে- মা যখন দুপুর ১২টায় এক কাপ চায়ের সঙ্গে পিঁয়াজ-মরিচ দিয়ে আটার চাপড়ি বানিয়ে দেয়।
আজ রাতে এক হাত দেখে নেবে শাকিলাকে- ভাবতে ভাবতেই বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়ে মিথিলা।
মিথিলার ঘুম ভাঙল অনিলা ঘরে ঢোকার পর। ব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলে রাখার পর ধুপ করে বসে পড়ল যখন বিছানার ওপর। জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে অসময়ে ঘুমাচ্ছিস কেন? শরীর খারাপ?’ অনিলাই একমাত্র মানুষ যে জানতে চায় মিথিলার কি হয়েছে। মিথিলা উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আদা চা বানাতে যাচ্ছি, তুই খাবি?’ ‘আমি খাব। অনিলা বলল, ‘তা হলে মাকে চা দিতে মানা কর। তুই আদা চা করে আন।’
মিথিলা দুই কাপ চা বানিয়ে এনে বোনের সঙ্গে বসল। শাকিলার বাচ্চাটা তখনও ঘুম থেকে উঠে মোচড়ামুচড়ি করছে। মিথিলা বলল, ‘তোর কি মনে হয় না শাকিলা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেছে? রাত এত হলো, বাসায় আসার নাম নেই’। বাচ্চাটাকে কুকুর-বিড়ালের বাচ্চার মতো পয়দা করে ছেড়ে দিয়েছে। কোন খোঁজখবর রাখে না বাচ্চাটার। অনিলা বলল, ‘হুম, জন্ম যখন দিয়েছে তখন ওর বাচ্চাটা বড় না হওয়া পর্যন্ত, বুঝতে না শেখা পর্যন্ত খেয়াল রাখতে হবে।’ মিথিলার মাথার মধ্যে চড়াৎ করে উঠল, কলিজাটা কাঁপছে। মিথিলা অনিলাকে আবারও জিজ্ঞাসা করল, ‘যতদিন বুঝতে না শেখে, তুই কি এটাই বলেছিস?’ ‘হুম! এটাই বলেছি, তুই এত ইমো খাচ্ছিস কেন?’
মিথিলার বোধের আকাশে আজ আর একটা কাঁটা বিঁধল। মিথিলা বলল, ‘নারে প্যারা খাচ্ছি না, এমনি বললাম। বাচ্চাটা সারাদিন পায়ে পায়ে কুকুর-বিড়ালের মতো ঘোরে। তোর কি মনে হয় না, শাকিলা যদি মায়ের দায়িত্বটা ঠিকমতো করতে না পারে তো ওকে এতিমখানায় দিয়ে আসা ভাল? অযথা সমাজের কাছে নিজেদের বড়-মহান দেখাবার জন্য ছোট্ট জানটাকে কেন আমরা হাতিয়ার বানিয়েছি। আসলেই বল তো, এই পরিবারে মহান হবার কি দরকার আছে?’ আবার অনিলা রাগের সুরে বলল, ‘মিথিলা চুপ কর, সময়ের আগে বড় হবার দরকার নেই। তুই ছাড়াও এই সংসারে বড় অনেকেই আছে, যারা ভালমন্দ বোঝে। মিথিলা বলল, ‘হাঁ ঠিক ভালমন্দ মাই ফুট। তুই ক্লাসে যাস না কেন? আমার ক্লাসে যেতে ভাল লাগে না। আমি ক্লাসে যাব না। অনিলা বলল, তোর ক্লাসে যাবার জন্য ভাল লাগার না লাগার কি হলো? লেখাপড়া তো করতেই হবে নইলে জীবনে কিছু করতে পারবি না। আমি আর পড়ালেখা করব না। আমার পড়ার পেছনে আর টাকা খরচ করবি না তুই। আর কি কিছু? তোর মতো কিছু?
মিথিলা এবার অনিলার কাঁধে একটা হাত রাখল, বলল, ‘তুই তো পড়েছিস আপু, শাকিলা পড়েনি। কিন্তু তোর আর শাকিলার মধ্যে কি কোন পার্থক্য আছে? শুধু তোরা আলাদা আলাদা ব্যানারে একই কাজ করছিস। একটু ভিন্নভাবে।’
মনে হচ্ছিল অনিলার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে। চোখের পানির যে এত প্রেসার থাকে অনিলা আগে কোনদিন জানত না। আজ ছোট বোনটা কি ঠাণ্ডাভাবে চরম সত্য কথাটা বলে গেল দাড়ি-কমা ছাড়া! অদ্ভুত এক ভাল লাগায় অনিলা মিথিলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘কিরে, মাথা এত গরম কেন? টাকাপয়সা লাগবে নাকি?’ মিথিলা এবার বলল, ‘তুই আমার অহঙ্কার কোনটা তা তো জানিস। কোন্ অধিকারে তুই আমার অহঙ্কারের জায়গাটা নষ্ট করলি?’ আবার অনিলা মিথিলার হাতটা বুকে চেপে ধরে বলল, ‘তুই যে অনেক ছোট আর তাই বুঝিস না। আমার স্বপ্ন আছে, ইচ্ছা জাগে। কিন্তু কি করব বল, এতগুলো জীবন, এতগুলো মুখের আহারের জন্যই স্বার্থপর হতে পারি না।’ মিথিলা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এসব মুখের জন্য খাবার যোগাড়ের দায়িত্ব তোর না। জন্ম তো তুই দিসনি। তুই তো একটু আগেই শাকিলার ছেলের বেলায় বললিÑ ‘জন্ম যখন দিয়েছে তখন বুঝতে শেখার আগ পর্যন্ত দায়দায়িত্ব আছে।’ অনিলা বলল, ‘জন্ম কি শুধু পেট থেকেই দেয়, না পাগল একজন মানুষের বোধের আড়ালে অনেক কিছুর জন্ম হয়? যেমন আমার ছোট ভাইবোনগুলোর জন্ম আমার বোধেই জন্ম আর তাই আমি এখন কোন কিছু ভালমন্দের বিচার করি না।’ টস টস করে অনিলার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
মিথিলা চেয়ে দেখছে। একই মায়ের পেটের বোন এমন আকাশ-পাতাল হয় কেমন করে? অনিলা কাঁদছে বলেই কি ওকে আজ বেশি সুন্দর লাগছে? হিংসা হচ্ছে না কেন মিথিলার? মিথিলা ভাবছে। অনিলা চোখ মুছে বলল, ‘আমাদের হাবলুটা কোথায়রে?’ মিথিলা আবার মুখ শক্ত করে বলল, ‘আর কোথায় হবে, বাবা-মার ঘরে। বুড়ো বয়সের ভীমরতি আর মেয়ের কামাই খেয়ে লোকটা সুখেই আছে। কিন্তু সুখবোধ আর কয়দিন ধরে রাখবে, প্রকৃতি তাকে খুব জলদি এই সুখবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।’ অনিলা গোঙানির মতো করে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কি বলতে চাস তুই? তুই কি মৃদুলের দিকে দেখিস না আপু? তুই কি বুঝতে পারিস না ও আর দশজন বাচ্চার মতো নরমাল না?’ অনিলা আবার সব বাঁধ ভেঙ্গে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। ‘বুঝি মিথিলা আমার কষ্টের দরজা-জানালা খুলে বসলে কি এর সমাধান হবে? একদিন আমি চলে যাব। আর কি করতে পারি এই পরিবারটার জন্য?’ মিথিলা বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই তো সব করছিস। তোকেইবা কেন দোষ দেব? আমার জেদ হয় ওই লোকটার ওপর, যে কিনা জন্ম দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছে না।’ অনিলা বলল, ‘আমার অংশগ্রহণ এই সংসারে মাত্র তিন বছর। তার আগে বাবাই সব দেখেছেন। সে যেভাবেই হোক না কেন।’ মিথিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপু তুই বলত, কতটা শ্রদ্ধা তোর তার ওপর আছে?’ ‘বাদ দে না এসব।’
‘শাকিলা কেন রাত করছে, দেখ তো একটা ফোন করে।’ মিথিলা বলল, ‘না ওকে আমি ফোন করব না; ও এখন বাচ্চা না বরং বাচ্চার মা। যা কিনা ও ভুলে গেছে।’
‘আপু মৃদুলকে বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না। তুই কি জানিস, কোন অস্ত্রোপচার করে ওকে স্বাভাবিক ছেলেতে রূপান্তরিত করা যায় কিনা।’ অনিলা বলল, ‘যায়। টাকা লাগবে অনেক, আর লোকজানাজানি হবেই। সেটা একটা চিন্তার ব্যাপার না। আমি ডাক্তার বন্ধুদের কাছ থেকে খবর নেব।
এর মধ্যেই মা বলে গেল খাবার দেয়া হয়েছে। সবাই খেতে বসলাম। এর মধ্যেই শাকিলা এলো। মা খেতে ডাকল। সে বলল, ‘খেয়ে এসেছি, খাব না।’ বলেই রুমে চলে গেল। শাকিলা আর ওর ছেলে এক ঘরে থাকে। মৃদুল মা-বাবার সঙ্গে। অনিলা-মিথিলা এক রুমে। খাওয়া শেষ করে মিথিলা শাকিলার ঘরে ঢুকল। সে আজ শাকিলার বিডিনিউজ নিয়ে ছাড়বে। ঘরে ঢুকে যা দেখল, শাকিলা কাপড় না বদলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। জেদে নিজের ঘরে ফিরে একটা সিগারেট ধরালো। পাশের বাসার ছেলেটা দারুণ গিটার বাজায়। মিথিলার খুব ভাল লাগে। সে বসে বসে গিটার শুনছে আর সিগারেট খাচ্ছে। এরই মধ্যে অনিলাও পাশে বসল। বলল, ‘দে আমায় একটা জ্বালিয়ে দে।’ অনিলা বলল, ‘বাহ! ছেলেটা তো দারুণ বাজায়।’ তারপর চুপচাপ দুই বোন। কোন কথা নেই শুধু সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। মিথিলা বলল, ‘বাবা-মার ভুলের সন্তান আমি। সেটা জেনেই আমি তোকে বলছি, তুই ভালবাসার সন্তান তাদের। নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না এভাবে। নিজের কথা কিছু নিজেই ভেবে নে।’ অনিলা বলল, ‘খুব বেশি পেকেছ। এখন ঘরে চলো ঘুমাবে।’
মিথিলা জোরে হেসে উঠে বলল, ‘পেকেছি তো বটেই; মানুষের তাকানো দেখলে সেটা বুঝতে পারি। আমি আমারই রক্তের মধ্যে বপন করি আমার অহঙ্কার, আর সেই থেকে ধেয়ে আসে জোয়ার ঘৃণার।’ অনিলা বলল, ‘কি ওসব বকিস তুই আজকাল? চল ঘুমাবি’। ‘তুই যা আমি আসছি।’ অনিলা চলেই যাচ্ছিল। মিথিলা বলল, ‘দাঁড়া।’ ‘অনিলা ঘুরে দাঁড়াল। মিথিলা আবার বলল, ‘তোর ইচ্ছা করে না ঘর বাঁধতে?’
অনিলা মিথিলার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘হ্যাঁ করে, অনেক করে। কিন্তু আমি যে ঘরটায় বাধা পড়ে গেছি।’ বলেই ভেজা চোখে গট গট করে ঘরে ঢুকে গেল।
মিথিলা বারান্দায় বসে রইল। কেমন যেন রহস্যময়ী পৃথিবীটাকে লাগছে। চাঁদ মিটিমিটি হাসির সঙ্গে চিকন খোঁচা দিচ্ছে। যদিও ঘোলাটে মেঘ চাঁদের স্বচ্ছ আলোকে গ্রাস করে ফেলেছে। আরেকটা সিগারেট ধরালো মিথিলা। আহা! কি অদ্ভুত সুন্দর গিটারের আওয়াজটা। নেশা লাগছে আজকের এই রাত, গিটার, রহস্যময়ী চাঁদ আর নিজ বাস্তবতা।
বেট লাগিয়ে বলতে পারি, পৃথিবীর কোন আর নেশা নেই যা আজকের মতো নেশা আমায় ধরাতে পারে। আজ হঠাৎ গিটার বাদকের সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায় বারান্দায়। দেখতে তেমন সুন্দর না কিন্তু চোখের মধ্যে যেন কি আছে। বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। মিথিলা এমনিতেই অসামাজিকতায় অভ্যস্ত নয়, তাও এক-আধবার চোখাচখি হয়েছিল। আরও একটা সিগারেট ধরালো, আবার মনটা বিস্বাদে তিতা হয়ে গেল, আর ক্রোধে মগজটা গরম। কারণটা মিথিলা জানে। ওই ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তা করাটাই ওর বিরক্তি লাগছে। কিন্তু মেজাজ আবার শাকিলার ওপর বিগড়ালো। ওকে চড়টা মারতে পারলে হয়ত আজ শান্তি পেত। ঘুমও আসছে না। যদি একটা মোবাইল থাকত তা হলে হয়ত কোন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটান যেত কিংবা গিটারবাদকের সঙ্গে।
যত সময় যাচ্ছে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, অস্থিরতা বাড়ছে।
অনিলা সকালে ঘুম থেকে ওঠে অফিসের জন্য। মিথিলা ঘুমাচ্ছে। একটা কাগজ-কলম নিয়ে ছোট্ট একটা নোট লেখল মিথিলার জন্য। “কালের ছোবল উজাড় করে যখন স্বপ্নের আকাশ, জীবনকে বেঁধে দেয় সীমাবদ্ধতায়, বপন করে মৃত্যুঞ্জয়ী ভাললাগা, যার অসীমতা ছুঁতে পারে না চিরসত্য মৃত্যু।” কাগজটা মিথিলার মাথার কাছে রাখে। আরও লিখল জীবনে সব স্বপ্ন সবার জন্য নয়, কিছু স্বপ্ন শুধুই স্বপ্নে ভাল লাগে। তবে আমারও স্বপ্ন পূরণের সাধ জাগেরে মিথু। আচ্ছা শোন, আজ তোর জন্য একটা মোবাইল আনব। তুই সারাদিন একা বড় মন খারাপ করে থাকিস। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে তোর ভাল লাগবে, আপু।
নোটটা রেখে মিথিলার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মিথিলা নোটটা দেখল কিন্তু পরে পড়বে ভেবে রেখে দিল। প্রথমেই নাইটস্যুট পরেই বারান্দায় গেল। মিথিলার নাইটস্যুট হলো ঢিলা পায়জামা আর টি-শার্ট। বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখে ছেলেটিকে। খুব সম্ভবত ওর নাম অর্ঘ্য। মিথিলাকে দেখে ছেলেটি ঘরে ঢুকে গেল। একটু পরে ওর বোন এলো। সে আজ নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘এই, তুমি এত পাশে থাক, কথা বল না কেন?’ মেয়েটির নাম অর্পিতা। মিথিলা বেশ লজ্জা পেল। ঠিক বুঝতে পারছিল না কি উত্তর দেবে। বলল, ‘না, বলতাম। কিন্তু ভাল কাজটা তো তুমি আগে করে নিলে।’ ‘যাক, আমি মিথিলা’ বলতেই মেয়েটি বলল- ‘তোমার কিছুই বলতে হবে না। তোমাদের সম্পর্কে সব জানি।’ ‘আমরা তো নতুন এসেছি। আমাদের এখানে একবার বেড়াতে আসা তোমার উচিত ছিল। আমরা একই বয়সী।’ আবার মিথিলা কিছু বলার সুযোগ পেল। বলল, ‘তুমি খুব মিষ্টি করে আর আপন করে কথা বলতে পার। আমি পারি না। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারলে আমারও ভাল লাগবে। আসব একদিন।’ অর্পিতা বলল, না, একদিন না। আজই আমি আসব তোমায় নিতে আর তোমার বাবা-মার সঙ্গে আদাব-সালাম করে আসব।’ মেয়েটি অসম্ভব শার্প আর ভদ্র। মিথিলা নিজের ঘর নিয়ে মোটেও তৃপ্ত নয়। বুকটা ধড়াস করে উঠল। কি যে যন্ত্রণায় ফাঁসলাম! মানাও করা যাবে না। ঠিক হলো অর্পিতা এগারো-বারোটায় আসবে। আজ দুপুরে ওদের ওখানেই মিথিলা খাবে।
মিথিলা বোনের চিরকুটটা বের করল, পড়ল। মাথায় তেমন কিছুই ঢুকল না। শুধু জানল, আজ ওর জন্য মোবাইল আসবে। খুব খুশি লাগল। অনেকদিন পর আজ মিথিলা খুশি হলো। এই খুশি শুধুই মোবাইলের জন্য নয়, সেটাও বুঝল। মিথিলার তেমন কোন কাপড়-চোপড় নেই। সে জিন্স আর টি-শার্টই পরে। আজ একটা কালো জিন্সের সঙ্গে ফিরোজা টি-শার্ট পরল। যদিও মিথিলা শ্যামলা কিন্তু কখনই রং বেছে পরে না। মিথিলার বিশ্বাস, সব রঙের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, আর সেটা মানুষের গায়ের রয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। মানাক বা না মানাক; বোল্ডলি মিথিলা সব রং পরে।
বেল বাজতেই মিথিলা দরজা খুলে অর্পিতাকে স্বাগত জানাল। নিজের রুমে নিয়ে বসাল। অর্পিতা বলল, ‘বাহ! তোমার রুমটা চমৎকার, ছিমছাম। বাড়তি কিছু নেই, আমার এমনটা খুব ভাল লাগে।’ মিথিলার ঘরে একটা বিছানা আর ড্রেসিং টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই। আবার অর্পিতা বলল, ‘চল, তোমার বাবা-মার সঙ্গে পরিচিত হই।’
ওকে নিয়ে বাবার ঘরে গেলাম। বাবা কাগজ পড়ছিল। ওকে দেখে হেসে নাম জিজ্ঞাসা করল। তারপর এ-কথা সে-কথা। বাবা অনর্গল ইংরেজীতে ওর সঙ্গে কথা বলছে দেখে মিথিলা এই প্রথম বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম। এই প্রথম বাবা আমায় মুগ্ধ করে দিল। অনেক কথার মাঝে উঠে এলো বাবা যে আগে পেন্টিং করতেন সে কথা। অর্পিতা বলল, ‘আমাদের ঘরে আপনার একটি পেন্টিং আছে। ওটা আমি আমার বাবার কাছে আবদার করে কিনেছিলাম। ওই পেন্টিংটায় একটা মেয়ে হাঁটু গেড়ে দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে বসে আছে, আর তার বাম দিকের চোখ থেকে পানি নয় রক্ত বের হচ্ছে। আমি পেন্টিংটার কিছুই বুঝিনি; তবে আমার খুব ভাল লেগেছিল।’ মিথিলার বাবা বলল, ‘ওটাই আমার জীবনের শেষ পেন্টিং ছিল। ইচ্ছা ছিল নিজে রাখব কিন্তু পারিনি। অল্প কিছু টাকায় গুলশানের এক দোকানে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আর পেন্টিংটা মিথিলা যখন ওর মায়ের পেটে তখন আঁকা। এরপর ছেড়ে দিয়েছি।’ মা চা আর সমুচা আনল অর্পিতার জন্য। অর্পিতা খুব আগ্রহ নিয়ে খেল, কিন্তু স্রেফ একটাই। তারপর বলল, ‘চাচা আজ মিথিলাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি। আমরা একসঙ্গে দুপুরে খাব। তারপর গল্প করে বিকালে একটু ঘুরে ও চলে আসবে।’ মিথিলার বাবা বলল, ‘বেশ তো যাও। এটাই তো জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময়। মড় ধহফ বহলড়ু ুড়ঁৎংবষভ’. আবার মিথিলা বাবার মুখটা ভালমতো দেখল। কথায় যেন বাবাকে সে চিনতে পারেনি!
অর্পিতাদের বাসাটা ছবির মতো। ওর বাবা দেশে কম থাকেন। মা-ও খুব স্মার্ট। খুব সুন্দর করে কথা বলেন। অনেকক্ষণ ড্রইংরুমে বসে কথা বলল ওরা। আবার অর্পিতা মিথিলাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকেই পেন্টিংটা মিথিলার চোখে পড়ল। একদম জীবন্ত। অথচ জীবনেও সে জানত না, তার বাবা একজন শিল্পী। তাঁর শিল্পকর্ম অন্য বাসায় এসে দেখল। রাগ হলো মনে মনে বড় বোন আর মার ওপর। ওরা কেন কোনদিন মিথিলাকে এ কথা জানায়নি!
অনেকক্ষণ পর অর্পিতার ভাই এলো। অর্পিতা পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করার আগেই সে বলল, ‘আমি চিনি ওকে।’ অর্পিতা বলল, ‘তোরা গল্প কর, আমি একটু আসছি।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অর্ঘ্য বলল, ‘তুমি এত সিগারেট খাও কেন?’
মিথিলা চুপ। অর্ঘ্য আবার বলল, ‘তোমার ভাল লাগে, তাই, না? তোমার কোন বন্ধু নেই, ওই সিগারেটই তোমার বন্ধু।’ মিথিলা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি করেন?’ অর্ঘ্য বলল, ‘প্রথমে তো আপনি নয়, আমায় কেউ আপনি বললে আমার ভাল লাগে না। আমি গইঅ করছি।’
অর্পিতা এলো। তিনজন মিলে অনেক গল্প হলো। আবার খাবার খাওয়ার পালা। সেটাও শেষ হলো। এর মধ্যেই অর্ঘ্যর এক বন্ধু এলো। দেখেই বোঝা যায়, ভীষণ রকমের বড়লোক হবে! ওর গাড়িতে করেই বিকালে বের হলাম ঘুরতে। ক্লাব জেলেত-এ আইসক্রিম খেলাম। ছেলেটা বিল দেবে কিন্তু অর্ঘ্য কিছুতেই সেটা দিতে দিল না। যখন ফিরে আসছি অর্ঘ্য, অর্পিতা ওর মায়ের পছন্দের আইসক্রিম নিচ্ছিল, ছেলেটা বলল, ‘ুড়ঁ যধাব াবৎু ংবীু ভরমঁৎব, সধু ও যধাব ুড়ঁৎ পবষষ হড়.?’ আমি বললাম, ‘আমার সেলফোন নেই; তবে আজ আপু নিয়ে আসবে।’
‘ওহ! গুড। নম্বরটা দিও।’
এরই মাঝে ওরা দু’জন চলে এলো। গাড়িতে অর্পিতাও আমার নম্বর জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি বললাম, ‘কাল দেব। আজ এখন পর্যন্ত আমার কোন নম্বর নেই।’
বাসায় ফেরার পর মিথিলা বলল, ‘এখন যে যেতে হবে।’ অর্ঘ্য বলল, ‘তুমি আবার আসবে।’ মিথিলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।’
বাসায় ফিরে বাবার ঘরে গেলাম। বাবাকে বললাম, ‘তোমার পেন্টিংটা খুব সুন্দর আর জীবন্ত। তুমি কি আমায় এঁকেছিলে?’ বাবা কথার উত্তর না দিয়ে বলল, ’কেমন ওরা?’ মিথিলা বলল, ‘খুব ভাল।’
মিথিলা নিজ ঘরে গিয়ে চিন্তা করছিলÑ আজ সারাদিন খুব ভাল কাটল, শুধু সাজিদ নামের ওই ছেলেটির কুদৃষ্টি ছাড়া। যদিও মিথিলার ফিগারটা আসলেই মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। কিন্তু তাতে তো আর মিথিলার করার কিছু নেই। যাক, এখন অনিলার জন্য অপেক্ষা।
আজ অনিলা তাড়াতাড়ি চলে এলো। হাতে একটা নকিয়া প্যাকেট ধরিয়ে দিল। অনিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মিথিলা। ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু পরে দেখে, অনিলা স্যুটকেস গোছাচ্ছে। মিথিলা বলল, ‘কিরে, কোথায় যাবি?’ অনিলা হাসতে হাসতে বলল, ‘ওই যে তুই বললি না ঘর বাঁধতে মন চায় কিনা! তো ঘর বাঁধতে যাচ্ছি।’
আপু মশকরা ছাড়। বল না, কোথায় যাচ্ছিস?’
অনিলা বলল, ‘অফিস থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি চার-পাঁচ দিনের জন্য।’ মিথিলা তারপর গড়গড় করে আজকের সব ঘটনা বলল।
অনিলা বলল, ‘তা হলে তো আজ তোর দিনটা অনেকদিন পর ভাল কেটেছে! বন্ধুত্বটা রাখিস। ওরা যখন ভাল মানুষ। অসুবিধা কোথায়?’ ‘হুম! কিন্তু আপু, আমি প্রথম কলটা অর্পিতাকে করতে চাই। কি করে নম্বরটা দেব?’ ‘পাগল! রাত মোটে আটটা। গিয়ে দিয়ে আয় না।’ ‘হুম, ঠিক বলেছ। কিন্তু উপরে উঠব, না ওদের দারোয়ানের হাতে দিয়ে অর্পিতাকে দিতে বলব?’
মিথিলা তাই করল। মিথিলার ফোন রিং বাজল কিন্তু অর্পিতা নয় অর্ঘ্য বলল, ‘এটা আমার নম্বর। সেভ করে রেখ। আমি অর্পিতাকে দিচ্ছি।’ অর্পিতা ফোন ধরেই এত খুশি হলো যেন ফোনটা এই নতুন হাতে পেয়েছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোনটা রেখে অনিলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে অভিমানের সুরে বললÑ ‘আপু তুইও তো কোনদিন বলিসনি বাবা পেন্টিং করত? জানিস, আজ বাবা কি সুন্দর করে অর্পিতার সঙ্গে ইংলিশে কথা বলেছে।’ অনিলা বলল, ‘মিথিলা, আমাদের বাবা সেই যুগের মাস্টার্স করা। তুই বাবাকে কি মনে করিস? বাবা এক সময় অনেক ভাল চাকরিও করত। সেখানে বাবার ওপর ষড়যন্ত্র করে চুরির দায় দেয়। বাবা তার সর্বস্ব বিক্রি করে। আমরা ঢাকা শহরে চলে আসি। এখানে বাবা ছোট একটা চাকরি পায়; সেটা দিয়েই আমাদের পড়ালেখা, সংসার চালায়। তারপর বাবার জন্মগত শারীরিক একটা ত্রুটি আচ্ছে । বাবার একটা কিডনি। সেখানেও সমস্যা। ডাক্তার কাজের চাপ কমাতে বলে, টেনশন করতে মানা করে। এভাবে আমরা আস্তে আস্তে নিচের দিকে গড়িয়ে যাই। চাচারা কিছু সাহায্য দিত আমার চাকরির আগ পর্যন্ত। তারপর শাকিলার ঘটনার পর সব বন্ধ। কেউ খবরও রাখে না।
সেই রাতের সমাচার শেষ হলো। পরদিন সকালে অনিলা চট্টগ্রাম যাবে, সে ঘুমাতে চলে গেল। মিথিলা বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাতেই ফোন বাজল। অর্ঘ্য বলল, ‘কম করো সিগারেট খাওয়া।’ মিথিলা হাসল। বলল, ‘তুমি কেন এত অস্থির হচ্ছ?’ তারপর অনেক গল্প হলো। মিথিলা বুঝতে পারল, অর্ঘ্য তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। সারারাত কথা হলো। অনেক কথা; যার কোনটার অর্থ আছে কোনটার নেই। কথা শেষ করার আগে অর্ঘ্য বলল, ‘জান, আমার কি মনে হয়, মনে হয় ইস্ এই মেয়েটিকে যদি আমি সুখী দেখতে পেতাম! তোমার অনেক কষ্ট, সেটা বুঝি। কিন্তু কিসের সেটা নিশ্চিত নই। তবে তুমি অনেক সুখী হবে।’ আবার হেসে বলল অর্ঘ্য, ‘আমাকে তোমার কেমন লাগে, মিথিলা?’ মিথিলা চুপ। কোন শব্দ নেই। অর্ঘ্য আবার জিজ্ঞাসা করল। মিথিলা বলল, ‘তোমার গিটার বাজানো আমার খুব ভাল লাগে।’ অর্ঘ্য বলল, ‘সরল উত্তরটার অপেক্ষায় রইলাম। যাও ঘুমাতে। আর একটিও সিগারেট খাবে না।’ মিথিলা সুবোধ বালিকার মতো ঘরে চলে গেল।
যতক্ষণ বিছানায় ছিল ছটফট করছিল। এই জীবনের প্রথম তাকে কেউ সত্যিকারের ভালবাসার প্রস্তাব দিল। কি করবে মিথিলা ?
অনিলা ঘুম থেকে উঠে বলল, ‘কিরে রাতে ঘুমাসনি?’
মিথিলা বলল, ‘না, ঘুম আসেনি।’ ‘কেন রে, কি হলো তোর?’ মিথিলা অনিলার গলা জড়িয়ে বলল, ‘এই প্রথম কেউ আমায় প্রেম নিবেদন করেছে।’ অনিলা বলল, ‘ওয়াও’! গুড। তা কে সে? ‘অর্ঘ্য।’ ‘হুম্ম, ছেলেটা তো ভাল। ফ্যামিলিও ভাল। তো বাধা কোথায়?’ মিথিলা বলল, ‘কোথাও না। ওর আগেই আমি ওর প্রেমে পড়েছি। আমি বলিনি, ও বলেছে।’ অনিলা তাড়াহুড়া করে বলল, ‘ঙক, গুড! আমায় বেরোতে হবে। সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম রওনা দেব। পাঁচ-ছয় দিন লাগবে। খেয়াল রাখিস সবার। আর তুই সুখী হ, এই দোয়া করি।’ মিথিলা বলল, ‘মনে হচ্ছে আর ফিরবে না। সারাজীবনের জন্য যাচ্ছ। যত ঢং শিখেছ না তুমি আপু। যাক, সাবধানে যেও।’ অনিলা বাবার হাতে মাসের মাঝখানেই বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলল-‘ওষুধ ঠিকমতো খেয়ো।’
অনিলা চলে গেল। মিথিলা অর্ঘ্যকে ফোন দিল। অর্ঘ্য ফোন কেটে দিয়ে কলব্যাক করল। মিথিলা বলল, ‘আজ বিকেলে বাইরে যাব? হুম্ম, তুমি রেডি থেকো, তিনটায়। কারণ পাঁচটায় বেটা সাজিদকে নিতে হবে, আগেই প্রোগ্রাম করা ছিল।’ মিথিলা বলল, ‘তা হলে অর্পিতাকেও নিতে পারি।’ অর্ঘ্য বলল, ‘না তার দরকার নেই। দুই ঘণ্টাÑ তুমি আর আমি শুধু।’
ওরা তিনটায় বেরুলো। অনেক কথা, গল্প, ভাল লাগা না লাগা; অনেক কিছুই কথা হলো। কিন্তু কেউ কমিটমেন্ট কিছুই করল না। ওটাই স্বাভাবিক। প্রথম দিনে কিসের কি? জানাশোনা আগে দরকার। অর্ঘ্য বলল, ‘আমরা দশ দিনের জন্য টক যাচ্ছি পরশু। আমি ওখান থেকেই কল দেব তোমায়।’ অর্ঘ্য এবার ঘড়িটা দেখল, ‘শালা টাইমটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। চলো সাজিদকে নিয়ে নিই, ওয়েসটিনে অপেক্ষা করছে।’ ওকে উঠিয়ে এমনি এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করল। বাসায় ফেরার সময় সাজিদ সঙ্গে এলো। সবাই আবার একটু অর্পিতাদের বাসায় বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিল। মিথিলা চলে আসার সময় সাজিদ মিথিলার ফোন নম্বর নিলো। বাসায় এসে মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অনিলা কল দিয়েছিল কিনা।’ ‘চারটার দিকে দিয়েছিল।’ মিথিলা কল করার চেষ্টা করল, হলো না। মিথিলা নতুন সম্পর্ক নিয়ে বেশ মউজে আছে। দু’দিন পার হলো, অনিলার কোন খবর নেই। সবাই ভাবল, হয়ত নেটওয়ার্ক প্রবলেম। বাবার মুখটা খুব চিন্তিত- বিষণœ। শরীরটাও খারাপ করেছে। অর্ঘ্যরাও টক চলে গেলো।
একদিন রাতে বাবার ভীষণ জ্বর। পেটে কোমরে পিঠে ব্যথা। বাবাকে হাসপাতালে নিতে হলো। শমরিতায় ওখানকার ডাক্তার সব দেখে বলল, অপারেশন করতে হবে কিডনি ম্যাচ করিয়ে। বিশাল টাকার অঙ্ক। মিথিলা পাগলের মতো ফোনে চেষ্টা করল অনিলাকে। ওর ফোন বন্ধ। অর্ঘ্য ওর ওখানকার নম্বর দিয়ে যায়নি। শাকিলা কোথা থেকে যেন বিশ হাজার টাকা আনল। সে রাতেই কিডনি ম্যাচ করানো হলো- মিথিলা-শাকিলা দু’জনেরটাই ম্যাচ করেছে।
কিন্তু টাকা? মিথিলা সাজিদকে কল দিল। সে এলো। টাকা সে দেবে। শর্ত একটাই- তার পিএ হয়ে থাকতে হবে। মাস মাহিনা পাবে। কিন্তু কোন কিছুতেই না বলতে পারবে না। মিথিলা বলল, ‘চলো, সব শর্তে আমি রাজি। ডাক্তারকে অপারেশনে প্রস্তুত করতে বলেই আমি তোমার সঙ্গে এক ঘণ্টা থাকব। তারপর টাকা সঙ্গে নিয়ে আসব। এর পর ১৫ দিন আমায় সময় দিতে হবে।’
সাজিদ লাফ দিয়ে উঠল। ‘তুমি কি চালাকি করার চেষ্টা করছ?’ ‘না, আমি আমার বাবাকে আমার কিডনি দেব। আর যদি তুমি ১৫ দিনের আগেই চাও তো আমি চলে আসব।’ সাজিদ বলল, ‘চল, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে যাই।’ সব ঠিক করে মিথিলা গাড়িতে উঠল। শাকিলা বাবাকে কিডনি দেবে না। কারণ তার ভবিষ্যত আছে। আর অনিলার অফিস থেকে মিথিলা খবর পেয়েছেÑঅনিলা এক অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে সেখানে বিয়ে করে চলে গেছে। কিন্তু বলল না কেন? অথৈ চিন্তায় মিথিলা নিজের বিসর্জনের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সাজিদ যখন তার শরীরে হাত রাখল তখন খেয়াল হলো। বাবার পেন্টিংটার কথা বড় মনে পড়ছে।
সাজিদ কড়ায়গণ্ডায় সব বুঝে নিল। সব শেষে মিথিলা ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে গেল। মিথিলার ফোনটা বিছানার ওপরেই ছিল। এরই মাঝে অর্ঘ্য কল করেছিল। সাজিদ কলটা ধরেছিল। অর্ঘ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুই মিথিলার ফোন ধরলি যে, তাও এই সময়? মিথিলা কোথায়?’ ‘আমার বাথরুমে।’ ‘মানে?’ সাজিদ অর্ঘ্যকে বলেছিল, ‘দোস্ত! একটা মেয়েকে নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বে কোন ফারাক আসবে না।’ অর্ঘ্য বলল, ‘ফোনটা রাখ। আর ওকে বলে দিবি, আমার সঙ্গে জীবনেও যেন কথা বলার চেষ্টা না করে।’ মিথিলার বাথরুম থেকে বের হবার পর টাকা সঙ্গে নিয়েই সাজিদ বের হলো। গাড়িতে ওঠার পর সাজিদ মিথিলাকে বলল, ‘অর্ঘ্য কল করেছিল।’ মিথিলা বলল, ‘আমায় দিলে না কেন?’ সাজিদ হেসে বলল, ‘অর্ঘ্য বলেছে-তুমি যেন আর ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা না কর।’ মিথিলা সব বুঝে গেল। অর্ঘ্য রাগ হবে, অভিমান করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একবার তো জানতে চাইতে পারত, কেন আমি এ সময়ে সাজিদের সঙ্গে। মিথিলার একবিন্দুও কষ্ট হচ্ছে না। মিথিলা মনে মনে আবার সেই পুরনো নিজের কবিতাটাকে নতুন করে বলতে শুরু করল “আমি আমারই রক্তে করি আমার অহঙ্কার বপন, আর সেই থেকে হয় মোর স্বপ্নের দহন”। হাসপাতালে পৌঁছে গেল। মা-শাকিলা সবাই খুব ভাল মতোই বুঝল, আমি কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম। কিভাবে টাকা যোগাড় করলাম। মা শুধু আমার কাছে এসে বলল, পৃথিবীতে মা সন্তানের জন্ম দেয়, আজ তুই সন্তান হয়ে তোর বাবা, মা, ছোট ভাইটাকে নতুন করে জন্ম দিলি! তোর ঋণ শোধ করার মতো স্পর্ধা আমার কেন আমার পেট থেকে বের হওয়া অন্য কোন সন্তানেরই নেই। বলেই মা আমায় বুকে চেপে ধরল। তারপর শাকিলার দিকে তাকিয়ে বলল-সব সন্তান তো আর এক হয় না। মার রাগ হলো। শাকিলার তো একবার বিয়ে হয়ে গেছে। ওর কিডনি দিতে সমস্যা কি ছিল। শাকিলা লজ্জা পেল কিন্তু অনুশোচনা মনে হয় না

No comments

Powered by Blogger.