ধর্ম- রমজানে কোরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ঐচ্ছিক ইবাদতের মধ্যে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত সর্বোৎকৃষ্ট। মাহে রমজান আল কোরআন নাজিলের মাস। এ জন্য রমজান মাসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও অনুশীলনের ফজিলত অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী। সুতরাং মানবজাতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থ আল কোরআন তিলাওয়াত করা, এর মর্ম হূদয়ঙ্গম করা এবং তদনুসারে আমল করা প্রত্যেক রোজাদার মুমিন মুসলমানের কর্তব্য।


তাই রমজান মাসকে রোজাদারগণ বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের মাস হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। মাহে রমজানে আল কোরআন তিলাওয়াতের ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে তা শিক্ষা দেয়, সেই সর্বোত্তম।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও রমজান মাসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন, কোরআন শরিফ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতেন। এমনকি প্রতিবছর মাহে রমজানে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) বারবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আল কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। এ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, তিনি বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) রাসুলে করিম (সা.)-এর খেদমতে হাজির হতেন এবং তাঁরা উভয়ই কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতদেরকে রমজান মাসে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াতের আহ্বান করেছেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘যদি কেউ আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বাক্যালাপ করার ইচ্ছা করে, তাহলে সে যেন আল-কোরআন তিলাওয়াত করে।’ মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পাঠ করে, সে একটি নেকি পায়, আর প্রত্যেকটি নেকি দশটি নেকির সমান।’ (তিরমিযি) তিনি আরও বলেছেন, ‘অন্তরের কলুষতা পরিষ্কার করার উপায় হলো বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং কোরআন তিলাওয়াত করা।’ (মিশকাত)
মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন মজিদ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানি কিতাব এবং মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ। পবিত্র রমজান মাসের বিশেষ মহিমান্বিত রজনী ‘লাইলাতুল কদর’-এ কোরআন শরিফ সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালে স্বর্গীয় দূত ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-এর মারফত আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ওহিযোগে ‘আল-কোরআন’ সর্বশেষ ও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হয়। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যেও পার্থক্যকারী রূপে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫) যখনই পবিত্র কোরআনের কোনো আয়াত বা সূরা অবতীর্ণ হতো, তখনই তা লিখে রাখার জন্য নবী করিম (সা.) নির্দেশ দিতেন এবং নিজেও তা মুখস্থ করে নিতেন আর সাহাবিদের মুখস্থ করে রাখতে আদেশ দিতেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা রাত্রিকালে আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১৩)
মহাগ্রন্থ আল কোরআন সংরক্ষণের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল শুধু তাঁদের দায়িত্ব পালন করা মাত্র। বস্তুত রমজান মাসে অবতীর্ণ হওয়ার প্রারম্ভ থেকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অপরিবর্তিত ও পূর্ণাঙ্গ সুসংরক্ষিত থাকা কোরআন মজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা মাহে রমজানে আল কোরআনকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআন হলো নূর বা হেদায়েতপ্রাপ্তির আলোকবর্তিকা। যে যত বেশি কোরআনের আলোয় আলোকিত হবে, সে তত বেশি সফলকাম হবে। আল কোরআন এমন এক বিশ্বসম্পদ, যা থেকে সারা দুনিয়ার মানুষ হেদায়েত পেতে পারে। তাই মাহে রমজানে বেশি বেশি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত নফল ইবাদতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নফল ইবাদতের মধ্যে কোরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তোমরা কোরআন মজিদ তিলাওয়াত করো, কারণ কিয়ামতের দিন তা স্বীয় পাঠকদের জন্য সুপারিশ করবে।’
রমজান মাসের সঙ্গে আল্লাহর কালামসমূহের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যই ওলামায়ে কিরাম, বুজর্গানে দ্বীন এবং আধ্যাত্মিক সাধকগণ এ মাসটিতে অধিক মাত্রায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন। সাহাবায়ে কিরামগণ রমজান মাসে আত্মসংযম অর্জনে সিয়াম সাধনার সঙ্গে সঙ্গে নূরে ইলাহি অন্তরে পয়দা করার জন্য অত্যধিক পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন। ইসলামের চার খলিফা মাহে রমজানে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং কোরআন শরিফ কয়েকবার খতম দিতেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) মাহে রমজানে সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেন। মুসলিম উম্মাহর বিখ্যাত পথিকৃৎ হজরত ইমাম আবু হানিফা (র.) দিনে-রাতে খতম, তারাবি নামাজে খতম আর আউয়াবিন নামাজে খতম—এভাবে প্রতি রমজানে কয়েক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। বরকত, রহমত ও কল্যাণের বারতা নিয়ে যখন মাহে রমজান হাজির হতো হজরত ইমাম শাফিঈ (র.) তখন দিনে-রাতে খতম করে পুরো রমজানে কয়েক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। (আইম্মায়ে আরবাআহ্, পৃ. ১৬৫)
আল কোরআন তিলাওয়াত করে তা মুখস্থ করা ও এর নির্দেশানুযায়ী জীবন যাপন করার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফরমান, ‘যে ব্যক্তি কোরআন তিলাওয়াত করে এবং তদনুসারে আমল করে, কিয়ামতের দিন তার পিতা-মাতাকে এমন এক উজ্জ্বল মুকুট পরানো হবে, যা দুনিয়ায় কোনো ঘরের মধ্যে অবস্থানরত সূর্যালোকের চেয়ে অধিক উজ্জ্বলতর হবে।’
অতএব, আল কোরআনের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বুঝতে অতি সহায়ক মাহে রমজানে রোজাদারদের পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত অন্যান্য মাসের চেয়ে বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন, যদিও সবার পক্ষে কোরআন শরিফ হিফ্জ করা সম্ভবপর নয়, তথাপি সাধ্যমতো গুরুত্বপূর্ণ সূরাসমূহ বা তার অংশবিশেষ অর্থ বুঝে শুদ্ধভাবে মুখস্থ করার চেষ্টা করা প্রত্যেকের জন্য কর্তব্য। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস মহাগ্রন্থ আল কোরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ঘটালেই ইহকাল ও পরকালের প্রকৃত সফলতা লাভ করা সম্ভব। মাহে রমজানে যথোপযুক্ত আদব, মোহাব্বত ও ভক্তিসহকারে প্রত্যহ কোরআন শরিফ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করার প্রতি সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক আল্লাহ পাক দান করুন!
 ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.