মুশফিকে মোহিত বাংলাদেশ by মাসুদ পারভেজ

দার্শনিকদের প্রতি ভদ্রলোকের দারুণ অনুরাগ। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডেপুটি ন্যাশনাল ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কক্ষের দেয়াল বা দরজায় সাঁটা খ্যাতিমান দার্শনিকদের বাণী অন্তত সে ধারণাই দেয়। তবে তাঁর কীর্তিমান এক ছাত্রের প্রসঙ্গ এসে যাওয়াতেই ধারণাটা প্রমাণিত। সেই ছাত্রের গুণগান গাইতে গিয়েই যে তিনি নিয়ে এলেন সক্রেটিসকে, ''সক্রেটিসের একটা কথা আছে, 'হোয়াট ইউ রিপিটেডলি ডু ইজ হোয়াট ইউ আর।' মুশফিককে আমি সেই বিকেএসপি জীবন থেকে 'রিপিটেডলি' ভালো করতে দেখে আসছি।


''ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকা মুশফিকুর রহিমের অধিনায়ক হিসেবেও সাফল্য না পাওয়ার কোনো কারণ দেখেন না তাই। অবশ্য শুরু দেখে একেবারে উপসংহারেও কিন্তু পেঁৗছে যাচ্ছেন না, 'বাট স্টিল অনলি দ্য বিগিনিং। যে জিনিসটা হয়নি, ওটা আমরা এখনো দেখিনি। সামনের এক বছরে কি হবে সেটা আমরা এখনো দেখিনি। ওর জন্য এটা পরীক্ষাই হয়ে থাকল।' ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে যে পরীক্ষায় বসেছেন মুশফিক। এবং প্রথম পরীক্ষায় কম-বেশি সবাই তাঁকে লেটার মার্কসই দিচ্ছেন। বিশেষ করে নির্বাচক হাবিবুল বাশার অভিভূত বোলারদের ব্যবহার করা দেখে, 'ওর বোলিং চেঞ্জ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। আপনারা দেখে থাকবেন, কাল (পরশু) শেষ ৫ ওভারে পাঁচজন বোলিং করেছে। বোলারদের খুব ভালোভাবে ব্যবহার করেছে। আমাদের সেরা বোলার সাকিবকে কিন্তু যখন সময় তখনই নিয়ে এসেছে। এককথায় মুশফিকের বোলিং চেঞ্জে অনেক চিন্তা-ভাবনার ছাপ ছিল।'
ক্যারিবীয়দের বেশি রান করতে না পারার পেছনে সে চিন্তা-ভাবনারই প্রতিফলন দেখেছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক এ অধিনায়ক, 'সেরা বোলারদের ঠিক সময়মতো ব্যবহার করেছে। এ জন্যই মনে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ বেশি রান করতে পারেনি। অনেক সময় এমন হয় যে মূল বোলাররা বল করে গেলে পার্টটাইমারদের বিপক্ষে রান করার সুযোগ তৈরি হয়। ওই সুযোগটা কখনোই দেয়নি। সেরা বোলারদের মধ্যে কেউ না কেউ আক্রমণে ছিলই।' একই ব্যাপার মুশফিকের বিকেএসপি জীবনের কোচ ফাহিমের নজরও কেড়েছে, 'ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঠিক পাঁচজন বোলার ব্যবহার করেছে। প্রত্যেককে দিয়ে প্রথমে ৩ ওভার করে ১৫ ওভার। শেষ ৫ ওভারে পাঁচজন। মানে একই বোলারকে প্রতিপক্ষ বারবার খেলার সুযোগ পায়নি।' অধিনায়কত্বের অভিষেকে এমন উদ্ভাবনী মুশফিককে সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছেন ফাহিম। বিকেএসপির ক্রিকেট কোচ হিসেবে যেমন পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলেও। স্মৃতির অতলে গিয়ে তাঁকে এমন সব বিশেষণই তুলে আনতে হচ্ছে, 'ভেরি অ্যাথলেটিক, ভেরি ওয়েল কো-অর্ডিনেটেড, ভেরি ওয়েল ডিসিপ্লিনড। পড়াশোনায় খুব ভালো। ছোট থেকেই এককথায় অলরাউন্ডার ছিল ও।'
এ অলরাউন্ডারের মাঝে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ অধিনায়কের ছায়াও ফাহিমের মতো আরো অনেকে দেখতে পাচ্ছিলেন কারণ, 'প্রথমত বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে ও ছিল নিয়মিত অধিনায়ক। দ্বিতীয়ত লিডারশিপ কোয়ালিটিও ছিল। এ জন্যই মনে হতো ও একদিন ক্যাপ্টেন হবে। মাঠের ভেতরের ব্যাপারে যেমন সচেতন ছিল, তেমনি মাঠের বাইরে ডিসিপ্লিনডও। ক্যাপ্টেন মানেই আমি সবচেয়ে বড়, আমি ভিআইপি_এসব জিনিস ওর মধ্যে নেই।' এর আগে এ দায়িত্বে থাকা কারো কারো বিরুদ্ধে দলের চেয়ে নিজেকে বড় ভাবার অভিযোগও ছিল। নেতৃত্ব হারানোর পেছনে সেটাও কম বড় ভূমিকা রাখেনি। এরপর যখন নতুন অধিনায়ক বেছে নেওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন অনেকেই ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না যে মুশফিক কতটা কী করে উঠতে পারবেন। মানে একটা আশঙ্কা ছিলই। তেমন কোনো সন্দেহ অন্তত ছিল না হাবিবুলের, যাঁর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল মুশফিকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার, 'ওর ভালো করা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। যদিও এখনই ওর সম্পর্কে কিছু বলে দেওয়া একটু আগেভাগে হয়ে যায়। আসলে দায়িত্ব নেওয়ার পরে বোঝা যায় কে কেমন ক্যাপ্টেন। আজহারউদ্দিনের কথাই ধরুন, দায়িত্ব নেওয়ার আগে যাঁকে কারো ভালো ক্যাপ্টেন বলে মনেই হয়নি। প্রথম ম্যাচে মুশফিকের ক্যাপ্টেন্সি আমার ভালো লেগেছে।'
ফাহিমের ভালো লাগার শুরুটা সেই বিকেএসপি জীবন ও বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকেই, 'ওই সময় অনেক ভালো উইকেটকিপিং করত। সেই তুলনায় এখন মাঝে মাঝে একটু খারাপ হয়ে যায়। তখন ওকে আমি খুব কম ব্যর্থ হতে দেখেছি।' ব্যর্থতায় মুশফিক ভীষণ ভেঙে পড়েন বলে একটা প্রচারণাও আছে। সেটি নিয়ে বলছেন, 'এখানেও ওকে নজর দিতে হবে। এটা বোধহয় নিজের কাছে ওর প্রত্যাশার স্তরটা অনেক উঁচুতে বলেই হয়।' অথচ বিকেএসপি জীবনে মুশফিক কিনা ওপেনারই ছিলেন। ফাহিম জানাচ্ছেন, 'আমাদের যেহেতু মনে হতো একদিন ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে, তাই ওর পজিশন বদলে দেওয়া হয়েছিল। কেননা ৫০ ওভার কিপিং করে আবার ওপেন করা চাপ হয়ে যেতে পারে ভেবে আমরা ওকে ছয় নাম্বারে ব্যাট করতে পাঠাতাম।' সেই বিকেএসপি থেকে শুরু করে জাতীয় দলেও দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে দেখছেন সতীর্থ আবদুর রাজ্জাক। অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকের প্রথম ম্যাচেই বড় একটা পরিবর্তনও চোখে পড়েছে তাঁর, 'ওই যে ছক্কা মেরে জেতাল, আগে ওরকম পরিস্থিতিতে ও আউট হয়ে যেত। ও যে পরিণত হচ্ছে বোঝা যায়।'
আর পরিণত হওয়ার পেছনে মনোযোগী ছাত্রের ভূমিকাও দেখেন তাঁর গুরু ফাহিম, 'অনূর্ধ্ব-১৭ থেকে ১৯ পর্যন্ত মুশফিক ক্লাস করার সুযোগই পায়নি। হাই পারফরম্যান্স টিম, এই ট্যুর সেই ট্যুর। এর মধ্যেই মুশফিকের সঙ্গে সব সময় ওর পড়ার বই থাকত। ওই পড়াশোনা দিয়েই এসএসসি ও এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়েছে। এখন জাহাঙ্গীরনগরেও খুব ভালো রেজাল্ট করছে।' ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তিনি। আর এ বিষয়টার সঙ্গে দার্শনিকদেরও একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। সক্রেটিসের ওই বাণীটাও তাই মুশফিকের জানা থাকার কথা। যে বাণীর মধ্যে তাঁকে খুঁজে পান গুরু!

মোট ম্যাচ : ১৭
বাংলাদেশের জয় : ৩
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ১২
পরিত্যক্ত : ২

বাংলাদেশের তিন জয়
* ২৬ জুলাই, ২০০৯, ডমিনিকা, ৫২ রানে জয়ী
* ২৮ জুলাই, ২০০৯, ডমিনিকা, ৩ উইকেটে জয়ী
* ৩১ জুলাই, ২০০৯, সেন্ট কিটস, ৭ উইকেটে জয়ী

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ : ২৭৬/৭
সর্বনিম্ন : ৫৮
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ : ৩১৪/৬
সর্বনিম্ন : ১৯৪
বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ : অলক কাপালি ৮৯*
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ : ব্রায়ান লারা ১১৭
বাংলাদেশের সেরা বোলিং : তাপস বৈশ্য ৫-১-১৬-৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা বোলিং : মারভিন ডিলন ১০-৪-২৯-৫

No comments

Powered by Blogger.