ট্রানজিট শীর্ষক সেমিনারে মির্জা ফখরুল : নতজানু সরকার দিল্লির স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত : বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়নি, ভারতের করদ রাজ্য হয়েছে : মাহমুদুর রহমান

ট্রানজিটের নামে করিডোর এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশ রক্ষার শপথ নিয়ে সরকার দেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। ৪০ বছর ধরে ভারত যেসব অন্যায় আবদার আদায় করে নিতে পারেনি, এবার তাদের অনুগত সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে তা আদায় করে নিয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল নতজানু এ সরকার ক্ষমতায় বসেই দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে দিল্লির স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।


সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে দৈনিক আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দেয়ায় বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের পরিবর্তে ভারতেরই করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা আর একশ্রেণীর কথিত বুদ্ধিজীবী বলে আসছিলেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার এ যুদ্ধে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পিন্ডির দখলমুক্ত হয়েছি। এবার আমাদেরকে দিল্লির গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্তির জন্য আরেকটি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। করিডোর রুখতে পেশাজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে শিগগিরই ঢাকা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ আয়োজিত সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও গবেষণা অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ, জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন, সাবেক সচিব আনহ আকতার হোসেন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, যুবদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম, ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক ডা. একেএম আজিজুল হক, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তাজমেরী এস ইসলাম, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, এক সময় ফিলিস্তিনে ও কাশ্মীরে শিশুরা নিহত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীতে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করত। অথচ এখন ভারত প্রতিনিয়ত সীমান্তে আমাদের নাগরিকদের গুলি করে হত্যা করছে, তার কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। এবার ভারত আমাদের কিশোরী ফেলানীকে গুলি করে হত্যা করে তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজের চোখ খুলে দিয়েছে। ফেলানীর মতোই আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভারতের কাঁটাতারে বিদ্ধ। তরুণ ও যুব সমাজকেই ভারতের এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের কথা বলে ভারত গত ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট নেয়ার চেষ্টা করে আসছে। বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছাড়া কিছু বুদ্ধিজীবী প্রতিনিয়তই বলে আসছেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আবার এদেরই কেউ কেউ বলছেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে ফি নিলে সেটা হবে অসভ্যতা। এখন আবার বলছেন- আমাদের লোকবল যতদিন পর্যন্ত তৈরি না হবে, ততদিন পর্যন্ত ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে ফি নেয়া হবে না। মূলত ভারতকে উজাড় করে দেয়ার জন্যই এদেরকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। তিনি বলেন, পেশাজীবী পরিষদ নেতা প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে, ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে না। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। জনাব মাহমুদুর রহমানের এ আশঙ্কার কথা অনেকেই প্রথমে গুরুত্ব দেননি। অথচ আজ সেটাই জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার জন্য আবদার করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদেরকে তো আগে আমাদের স্বার্থ দেখতে হবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে তারা ভারত চাওয়ার আগেই দিতে বাধ্য হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এক তিস্তা চুক্তিকে দেখিয়ে ভারত এর মধ্যেই ট্রানজিটের নামে করিডোর আদায় এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। দেশ রক্ষার তাগিদ নিয়ে দেশের তরুণ ও যুব সমাজসহ সকল শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, সরকার বাংলাদেশের সীমান্ত ও মানচিত্র দুটোই পাল্টে দিয়ে জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করেছে। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বাংলাদেশের সীমানার বিষয়ে বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আগে যেসব অঞ্চল ও সীমানা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল সেটাই হবে বাংলাদেশের সীমানা। অথচ সেই সীমানা এখন পাল্টে দেয়া হয়েছে। ভারতের কুচবিহার ও সিলেট জেলার একটি থানা করিমগঞ্জও বাংলাদেশের অংশ। ভারত যদি বাংলাদেশকে করিমগঞ্জ ও কুচবিহার বুঝিয়ে দেয়, তাহলে ভারতকে আমরা ট্রানজিট দেব কিনা, সেটা ভেবে দেখা যাবে। তার আগে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার অর্থই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভারতের কাছে বিকিয়ে দেয়া। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশকে তাদের অঙ্গরাজ্য না বানিয়ে পঙ্গুরাজ্য বানাবে। অঙ্গরাজ্য বানালে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সীমান্ত আগ্রাসন, পানি আগ্রাসন, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশকে পঙ্গু করার হীন চক্রান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশের মানুষ ২০২৫ সালে পরিবেশগত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
মেজর জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহীম বীরপ্রতীক বলেন, দেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই ২২ বছরের যুবক হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আজ কেউ কেউ নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে দাবি করেন। আমার প্রশ্ন হলো—মুক্তিযোদ্ধারা আবার কারো পক্ষের শক্তি কিংবা চেতনায় বিশ্বাসী হবে কেন? মুক্তিযোদ্ধারা তো নিজেরাই একটি শক্তি এবং চেতনা। আমি যদি প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযোদ্ধা হই তাহলে চেতনা কিংবা পক্ষের শক্তির প্রশ্ন আসবে কেন? যারা এসব শব্দ বেশি বলে তাদের মধ্যে অবশ্যই ঝামেলা রয়েছে। তা না হলে তারা এসব কথা বলতে পারে না। ৪০ বছর চেষ্টা করে গঙ্গা চুক্তি হয়েছে, পানি পাইনি। এখন তিস্তা চুক্তির চেষ্টা হচ্ছে, পানি পাওয়া যাবে কিনা জানি না। দুই নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়েই যদি ৮০ বছর চলে যায়, তাহলে ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির হিস্যা আদায়ে কত বছর লাগবে, আল্লাহই ভালো জানেন। তরুণ সমাজকে পিকনিক করার জন্য স্পট হিসেবে তিস্তা ব্যারেজ, যমুনা সেতু ও ফেনী নদী তীরকে পছন্দ করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, শীতের শুরুতেই তিস্তা ও যমুনা নদী শুকিয়ে কি অবস্থা হয় দেখে আসুন। আর চুক্তি করেও আমাদেরকে ভারত পানি দেয়নি। অথচ আমাদের ফেনী নদী থেকে ভারত চুক্তি ছাড়াই পানি উঠিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানাচ্ছে। এগুলো দেখুন আর বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবুন। তিনি বলেন, আগামী ৫ বছর পর বাংলাদেশকে বর্তমান অবস্থায় দেখতে পাব কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বুটের তলায় আজ দেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার পিষ্ট হচ্ছে। তরুণ সমাজ জেগে উঠলে বুট ও বুলেট দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি বলেন, সেই তরুণ সমাজকে নিয়ে আমি আরেকটি যুদ্ধে নেমে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছি।
সভাপতির বক্তব্যে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক ও দৈনিক আমার দেশ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব শুধু হুমকির মুখেই নয়, এরই মধ্যে তা হরণ করা হয়ে গেছে। ছিনতাই হওয়া স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব উদ্ধারে এখন লড়াইয়ে নামতে হবে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বিনা বাধায় লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আবার ফেরত দিয়ে যাচ্ছে। এটি কোনো স্বাধীন দেশের নমুনা হতে পারে না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগের দিন সেদেশের মন্ত্রীরা বললেন, তিস্তা চুক্তি হবে না। অথচ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, চুক্তি হবেই। শেষ পর্যন্ত হলো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বলা হলো—তিস্তা চুক্তি হয়নি, তাই আমরা ট্রানজিট চুক্তিও করিনি। অথচ এখন কি দেখা যাচ্ছে? চুক্তি ছাড়াই কি ভারত বাংলাদেশের ভেতরে জাহাজ পাঠিয়েছে। এখনও ভারতের তিনটি জাহাজ আশুগঞ্জ নৌবন্দরে পড়ে আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি বললেন, ট্রানজিটের ফি নেয়া হচ্ছে। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেল, কোনো ফি নেয়া হচ্ছে না। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, বাংলাদেশ ট্রানজিটের আয় দিয়ে সিঙ্গাপুর হবে। আসলে সিঙ্গাপুর হয়নি, হয়েছে ভারতের করদরাজ্য। ট্রানজিটের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে সেবাদাস বা কুলিতে পরিণত করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে পুনরুদ্ধারে আমাদের সবাইকে লড়াইতে নামতে হবে। শিগিগরই আশুগঞ্জ উপলক্ষে পেশাজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ কর্মসূচিতে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, চুক্তি হলো বাংলাদেশের বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো ভারতে দেখানো হবে। অথচ তা হয়নি। একতরফাভাবে ভারতের সব চ্যানেলই বাংলাদেশকে দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটাই হচ্ছে ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ভারত মূলত আমাদের তরুণ ও যুবসমাজের দেশপ্রেম আর জাতীয় চেতনাবোধ ধ্বংস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এ ধ্বংসের হাত থেকে তরুণ সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সাংবাদিক রুহুল আমিন গাজী বলেন, মনমোহনের সফরে সরকার ভারতকে সবই দিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য কিছুই রাখেনি।

No comments

Powered by Blogger.