হরতালের রাজনীতিতে বাংলাদেশ by তারেক শামসুর রেহমান

এক সপ্তাহের মধ্যে দু-দুটো হরতাল প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশ। ১১ ডিসেম্বর ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আর ১৩ ডিসেম্বর আধা বেলা। এর আগে ৯ ডিসেম্বর ছিল অবরোধ। ওই অবরোধ অনেকটা হরতালের মতোই পালিত হয়েছিল।
ধারণা করছি, বিএনপি তথা ১৮ দল সরকারের ওপর 'চাপ' সৃষ্টি করার লক্ষ্যে হরতালের মতো কর্মসূচি আরো দিতে পারে। খালেদা জিয়া সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এতে করে কি সরকার বিরোধী দলের দাবি মেনে নেবে? কোন পরিস্থিতির দিকে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি? অবরোধের সময় বিশ্বজিৎ মারা গেলেন। বলা যেতে পারে, তাঁকে 'হত্যা' করা হলো। সাহসী ফটোসাংবাদিকরা সেই ছবি তুলেছেন। যারা বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল, তাদের ছবি, নাম-ধাম_সবই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তারা ছাত্রলীগ করে। ছাত্রলীগের নেতা। পুলিশ তখন তাদের গ্রেপ্তার করল না কেন? মামলা একটা হয়েছে। করিৎকর্মা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সিটি করপোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। আমরা এতটাই বোধশক্তিহীন মানুষ যে আমাদের শুনতে হয়, মির্জা সাহেবের মতো মানুষ, যিনি একটি বড় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব_তিনি ময়লা টানার গাড়ি ভাঙচুর করেছেন। পুলিশ এ কাজটিই পারে। পারে না শুধু বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে। একটি রিট হয়েছে। রুলও হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মীর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে দুজন।
১১ ডিসেম্বরের হরতালের সময় যখন রিকশায় একাকী ঢাকার রাস্তায় ঘুরেছি, তখন অনেক কথা 'কানে' এসেছে। মানুষ অনেক কথা বলে। সব কথা শুনতে নেই। হিসাবটা মেলাতে চাই। একটা সমঝোতা কি আসলেই সম্ভব নয়? দেয়ালের লিখন থেকে কি কিছু শিখব না আমরা? আফ্রিকার সেই হুতু-তুতসিদের কাহিনীর কথা মনে আছে? দেশটির নাম রুয়ান্ডা। উত্তরে উগান্ডা, পূর্বে তানজানিয়া, দক্ষিণে বুরুন্ডি। লোকসংখ্যা মাত্র ৬১ লাখ। ১৯৯৪ সালে দেশটি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গৃহযুদ্ধ আর লাখ লাখ মানুষের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববাসী আঁতকে উঠেছিল। টিভি পর্দায় দেখেছিলাম সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি। হুতু ও তুতসি উপজাতি নিয়েই রুয়ান্ডা। জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশই হুতু উপজাতির। আর ১৪ শতাংশ হচ্ছে তুতসি। ঘটনা ৭ এপ্রিল, ১৯৯৪ সালের। একই বিমানে ফিরছিলেন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা, আর বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট নাটারিয়ামিরা। কিগালিতে (রুয়ান্ডার রাজধানী) বিমান অবতরণের ঠিক আগ মুহূর্তে রকেট হামলায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মারা যান দুই প্রেসিডেন্ট। সৃষ্টি হয় জাতিগত সহিংসতার। হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর তুতসিরা মেধাসম্পন্ন। অর্থনীতি ও সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৪ সালের গণহত্যাকারীদের হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়েছিল। কিন্তু হুতু-তুতসি দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে, তা বলা যাবে না। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আজ কোনো অবস্থায়ই সেই হুতু-তুতসির পরিস্থিতির সঙ্গে মেলানো যাবে না। জাতিগত বিভেদ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রকট, যা শুধু আমাদের কারো কারো মনে হুতু-তুতসি দ্বন্দ্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইতিহাস বলে, এ ধরনের ঘটনায় কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হয়। পাঠক স্মরণ করুন ২০০৮ সালের কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতির কথা। ওই দুটি দেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও সমঝোতার জন্য প্রেসিডেন্ট মুগাবে (জিম্বাবুয়ে) সাভাঙ্গিরাইকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আর কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কি বাকি বিরোধী নেতা অডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইউরোপের দেশ গ্রিসের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এ বছরের মাঝামাঝি সাবেক বিচারপতি পানাগিওটিস কিপরামানোসের নেতৃত্বে সেখানে সরকার ও পরে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ কী? সংকট মোকাবিলায় জাতিকে এমন সব সিদ্ধান্ত দিতে হয়, যা সংবিধান অনুমোদন করে না। এর পরও বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে করতে হয়। গ্রিসের মতো দেশও তো একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল? কেনিয়া বা জিম্বাবুয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা বাংলাদেশে তা পারব না কেন? অবশ্যই আমাদের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত নয়। সংবিধান সংশোধন না করি, সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা নিরপেক্ষ একটি সরকারের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে পারি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন 'মডেল' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে আন্তরিকতা। সরকার ও বিরোধী দলের এই আন্তরিকতা থাকতে হবে।
একটা বিষয় আমাদের স্মরণ থাকা ভালো_আর তা হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি। বিদেশে এ ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে একজন ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই ঝুলে গেল পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে_এ আশা যাঁরা করেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করেন। দুর্নীতিতে বিশ্বে আমাদের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম। দুর্নীতিতে প্রথম হইনি, এটাই রক্ষা! টিআইবির রিপোর্টে বলা হলো, সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে হলমার্কের এমডি এখন জেলে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের যাঁরা জড়িত, তাঁরা রয়ে গেছেন বাইরে। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা কি আদায় হবে? ডেসটিনি নিয়েও অনেক 'কাহিনী'। সে টাকাও তো উদ্ধার হলো না। যেখানে তাকাই, সেখানেই দুর্নীতি। আমাদের আশ্বাস আর বিশ্বাসের জায়গাটা থাকল না। আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লেগে মারা গেলেন ১১১ জন মানুষ। এটা ভয়ংকর একটা ঘটনা। একসঙ্গে শ্রমজীবী মানুষ এতজনের মৃত্যু একসঙ্গে হয়েছে, এ ইতিহাস আমার জানা নেই। শ্রম দিতে এসে, বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে এসে এতগুলো মানুষ প্রাণ দিল। ওইসব মৃত্যুর মূল্য কী মাত্র কয়েক লাখ টাকা? দেড় বছরের ছোট্ট শিশু সিয়াম এসেছিল মৃত মায়ের বকেয়া বেতন তুলতে। আমাদের মুনাফালোভী গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ওই অবুঝ শিশুর নিষ্পাপ ছবি দেখেও মন গলেনি। কেউ কি নিতে পারতেন না ওই শিশুর লেখা-পড়ার দায়িত্ব! আমরা এতই নির্বোধ জাতি_ওই কারখানার মালিক, যিনি এতগুলো মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, তাঁকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেল না। অথচ তথাকথিত 'গাড়ি ভাঙচুর' মামলায় গ্রেপ্তার হলেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু তাজরীন গার্মেন্টের মালিককে গ্রেপ্তার করা গেল না। আমাদের অনেক কিছু দেওয়ার আছে বিশ্বকে। ১৬ কোটি মানুষের দেশের নাগরিক আমরা। আমরা বিশ্বকে নেতৃত্বও দিতে পারব আগামীতে। কিন্তু ভয় হচ্ছে, আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগ তথা সাহায্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অবরোধের সময় আহত হয়েছেন একজন জার্মান স্থপতি। তাঁর আহত হওয়ার ঘটনা একটা ভুল 'সিগন্যাল' পেঁৗছে দিতে পারে ইউরোপে। পদ্মা সেতুর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অন্য প্রকল্পগুলোতেও অর্থ ছাড়ে শ্লথগতি আসতে পারে। তাই একটা সমঝোতা অত্যন্ত জরুরি। হরতালের পর হরতাল দিয়ে যেমন সরকারের পতন হবে না, ঠিক তেমনি সরকার যদি জোর করে থাকতে চায়, তার পরিণতিও ভালো নয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে একটা সমঝোতা হতেই হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে না উঠলে, আমাদের জন্য আরো খারাপ সংবাদ অপেক্ষা করছে। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সরকার যদি একটি সংলাপে যায়, আমার বিবেচনায় সেটা সরকারের জন্যও মঙ্গল। সরকার সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে_এটা সত্য এবং তা অস্বীকারও করা যাবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। কিন্তু তাই বলে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করার স্বার্থে নতুন একটি ব্যবস্থা যে প্রবর্তন করা যাবে না, তা তো নয়। আমরা তো সর্বশেষ গ্রিসের সিদ্ধান্তটিও অনুসরণ করতে পারি। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারেরও হুমকি দিয়েছেন। আমরা ভুলে যাই, অতীত বড় নির্মম। বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারও করেছিল। কিন্তু পরিণতি কি ভালো হয়েছে? নিশ্চয়ই সরকার যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু সংঘাত যখন তীব্র হচ্ছে, তখন এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই শ্রেয়। হরতাল কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং হরতাল আমাদের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে নষ্ট করছে। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আর পথ খোলা একটাই_সংলাপ।

লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
www.tsrahmanbd.blogspot.comআ

No comments

Powered by Blogger.