বিশ্ব অভিবাসী দিবস- প্রিয় অভিবাসী, আপনাকে অভিবাদন by মুনির হাসান

২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ব অভিবাসী দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ বছরও হয়েছে। এ উপলক্ষে শোভাযাত্রা, আলোচনা, টেলিভিশন টক শোর ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের দেশেও হয়েছে। অন্য অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশে এই দিবসের তাৎপর্য ভিন্ন হওয়াটা স্বাভাবিক।
সরকারি হিসাবে এখন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ৮০ লাখ অভিবাসী রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যাই এর চেয়ে কম। এদের সঙ্গে প্রতিবছরই নতুন নতুন লোক যোগ হচ্ছে। ২০১১ সালেই যোগ হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন। এই ৮০ লাখ অভিবাসী রয়েছেন বিশ্বের ১৪৩টি দেশে। যদিও তাঁদের ৯০ শতাংশকে পাওয়া যাবে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, মালয়েশিয়া, লিবিয়া ও সিঙ্গাপুরে।
১৯৭৩ সালে ওপেকভুক্ত দেশগুলো তাদের তেলের দাম বাড়াতে শুরু করে এবং রাতারাতি ধনী থেকে আরও ধনী হতে থাকে। নিজেদের দেশকে সাজানোর জন্য তারা ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়। তারা নির্মাণ করতে শুরু করে বড় বড় অট্টালিকা, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট। এগুলোকে আলোকিত করার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র, বড় বড় শপিং মল। নিজেরা ধনী লোক, কাজের লোক কোথায়? কাজেই শুরু হলো অন্য দেশ থেকে লোক আনা। বাংলাদেশও সে রকম একটা দেশ। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য যে ছয় হাজার ৮৭ জন দেশ থেকে বের হন, তাঁদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য। এই প্রবণতা এখনো বজায় আছে, যদিও নানা চড়াই- উতরাই রয়েছে ধাপে ধাপে। প্রতিবছরই এই হার বাড়ছে।
পরভূমে, কষ্টে, আক্ষেপে এবং কখনো কখনো মানবেতর জীবনযাপন করে এই প্রবাসীরা এই ছোট্ট দেশটির প্রতি তাঁদের ভালোবাসা, দরদ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বড় উৎস। ২০১১ সালে তাঁরা পাঠিয়েছেন এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি অর্থ। এই অর্থ স্বদেশ ভূমির জিডিপির ১৪ শতাংশ। এমনকি সেটা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ১৩ গুণ এবং তথাকথিত বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যের ছয় গুণও বটে!
তবে আমাদের এই নায়কদের কথা আমরা কখনো মনে রাখি না। বিশ্বাস না হলে যেকোনো দিন শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে দেখতে পারেন। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা এই মানুষটিকে কীভাবে আমরা দেশে স্বাগত জানাই, তা সামাজিক যোগাযোগের সাইটে তুলে ধরেছেন সিঙ্গাপুর-প্রবাসী শরিফুল ইসলাম। ‘আমরা যখন প্রবাসের ঘানি টেনে ক্লান্ত হয়ে একটু প্রশান্তির জন্য দেশে আপনজনের কাছে যেতে চাই, আমাদের প্রথম বাধা হয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। ওরা আমাদের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, শুনলে মনে হয়, মনিব কেনা গোলামের সঙ্গে কথা বলছে। আমি প্রথম দেশে যাওয়ার সময় দেখেছি পুলিশ পাশের মহিলা পুলিশের সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করছে। একজন প্রবাসী ভাই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “স্যার, একটু তাড়াতাড়ি করলে আমার সুবিধা হয়।” পুলিশ অফিসার রেগে থাপড়ের অ্যাকশন নিয়ে বলল, “কামলা খেটে এসেছিস, আবার বড় গলায় কথা বলিস।” এই হলো দেশের কাছ থেকে আমাদের পাওনা। কিন্তু কেউ এই পুলিশকে বোঝাতে পারবেন না, আমাদের মতো কামলা খাটা মানুষের জন্যই আজ তাদের এই চেয়ারে বসার সুযোগ হয়েছে।’
বিমানবন্দরে অভিবাসীদের বিড়ম্বনা নিয়ে অনেক লেখালেখি, প্রতিবেদন রচিত হয়েছে। তবে পরিস্থিতি সে রকমই আছে। অথচ অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী তিন লাখ ডলার বিনিয়োগ করবেন বলে জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধন করেন এবং মাত্র পাঁচ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে বিমানবন্দরে ভিআইপির মর্যাদা পান।
অন্যদিকে বিশ্বের অনেক দেশই এখন আর আমাদের শ্রমিক নিতে চায় না। দুঃখের বিষয়, এর কারণগুলো আমাদের বানানো। এর মধ্যে একটা হলো মেয়াদ শেষেও থেকে যাওয়ার চেষ্টা করা। এর কারণ, যত টাকা খরচ করে একজন শ্রমিক সৌদি আরবে যান দু-তিন বছরের জন্য, উদয়াস্ত খেটেও তত টাকা তাঁর ওঠে না। কারণ, অভিবাসনের খরচ। এমনও দেখা গেছে, অনেকে দু-তিন বছরের কাজের ছাড়পত্রের পেছনে দু-তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। ওই টাকা কি আর ওঠে? আমাদের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের লাভের ব্যাপারটা বোঝার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেওয়া যায়। কমবেশি পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দিয়েও বাংলাদেশ থেকে কোরিয়া গিয়েছেন অনেকে। অথচ, সরকারি মাধ্যমে এখন পাঁচ হাজার শ্রমিক যাচ্ছেন, যাঁদের খরচ হচ্ছে ৫৬ হাজার টাকা!
বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো আমাদের অভিবাসীদের সঙ্গে কত অসহযোগিতামূলক আচরণ ও দুর্ব্যবহার করে, সেটিও আমাদের অজানা নয়।
প্রিয় অভিবাসী, আমাদের ক্ষমা করবেন। আপনাদের যোগ্য সম্মান আমরা দিতে জানি না। তবে আমি জানি, একদিন না একদিন আমরা এই সম্মানের কাজটি শিখতে পারব। মহান সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আমাদের সেই পথ দেখাবেন।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

No comments

Powered by Blogger.