কৃষি-কৃষকের জন্য করণীয় by এম আব্দুল মোমিন

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা। প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার না থাকায় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কৃষিপণ্য নষ্ট হয়। আরেকটি বিষয়ে কৃষকদের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, তা হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা।
ফলে সেচ সংকটের সৃষ্টি হয় একটি টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় অবুঝ শিশু তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, 'বাবা চাষের কাজ কি খুবই খারাপ?' বাবার শক্ত জবাব, 'এই কাজ সবাই পারে নারে বাপ। সবার কাছে এটা মাটি কিন্তু এই মাটির বুক চিড়ে সোনা ফলাই আমরা, আমরাই তুলি শূন্য মাঠে ফসলের ঢেউ।' যে পেশা আমাদের অন্নের চাহিদা মেটায় তাকে অবজ্ঞা করা মোটেই সমীচীন নয়। কাজেই এ পেশা মোটেই অগৌরবের কিছু নয়; কিন্তু আমাদের দেশ ও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কৃষি ও কৃষককে আজও অবহেলার পাত্র হতে হয় পদে পদে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। বর্তমানে জিডিপিতে (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ২০.১৬ ভাগ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যখন খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১১০ লাখ টন ২০১০ সালে তা ৩৪০ লাখ টনে পেঁৗছেছে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাসস্থান, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমেই কমেছে; কিন্তু আশার কথা হলো তা সত্ত্বেও কৃষি খাতের নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি ও উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাত উদ্ভাবন এবং সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগের ফলে আমরা এখন পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে টিকে আছি এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণসহ সব ধরনের কৃষি সংশ্লিষ্ট খাত অতীতের তুলনায় কয়েকগুণ এগিয়েছে।
সরকার কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বেশ কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ সৃষ্টি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে এর আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকে ১ লাখ ৮০ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, যাতে কৃষিঋণ ও অন্যান্য সহায়তা সহজেই কৃষকের দোরগোড়ায় পেঁৗছানো যায়। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে কৃষকদের জন্য নেওয়া একই ধরনের পদক্ষেপ ইতিমধ্যে সফলতা পেয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে তা কতটা সফলতা পাবে, তা এখন দেখার বিষয়। কেননা এর চেয়ে অনেক জরুরি অনেক বিষয় এখনও সমাধান হয়নি বা সমাধান করা যায়নি।
বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি হিসাব করা হলেও সম্প্রতি শেষ হওয়া আদমশুমারিতে তা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে দু'বেলা পেটপুরে খাওয়ানোর নিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কৃষি ও কৃষকের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। ব্যাংক, এনজিও এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কৃষকের লিংকেজ আরও শক্তিশালী গতিশীল করতে হবে, যাতে ঋণ পাওয়া সহজ হয়। পাশাপাশি প্রাপ্ত ঋণ সময়মতো সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য তাদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদানের জন্য একটি নিবেদিতপ্রাণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান হতে পারে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে, যাতে নির্ভরযোগ্যতা বাড়ে। কেননা আমাদের পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্যতার প্রশ্ন এড়াতে পারেনি।
কৃষিঋণের অপ্রতুলতার কথা না বললেই নয়। বর্তমানে দেশের আনুমানিক কৃষি ঋণের চাহিদা প্রায় ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ২০১১ সালে বিতরণ করেছে মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চাহিদা ও বিতরণের এ ব্যবধান ঘোচানোর জন্য ব্যক্তিখাত, এনজিও ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশীদারিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ এবং উৎসাহ জোগানো জরুরি। আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কৃষিঋণ ও উপকরণ সহায়তা থেকে মুনাফার আশা করা সমীচীন নয় এবং বর্তমানে এ ঋণের জন্য আরোপিত-নির্ধারিত সুদের হার পুনর্নির্ধারণ অথবা একেবারেই বাতিল করা যায় কি-না, তাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের কৃষিখাতের অন্যতম সমস্যা কৃষিঋণের সুদ নয় বরং ঋণের সহজলভ্যতা। এই সাফল্য এখনও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।
কৃষিজমির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকের ক্যাশ নিরাপত্তা এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। যদি আবাদি জমি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার এবং সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে উর্বরতা বাড়ানো যায় তাহলে উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য আরও বেশি পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ক্রয়ের জন্য ৩-৫ বছর মেয়াদি ঋণ সহায়তা বাড়াতে হবে। কৃষি জমির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জমির লিজ রেট বাড়ানো প্রয়োজন।
কৃষি সমস্যা সমাধানে কন্টার্ক ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতি একটি মোক্ষম সমাধান হতে পারে। কন্টার্ক ফার্মিংয়ের আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ও গুণগত মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য গ্রাহক বা ক্রেতা সরাসরি চাষির কাছ থেকে ন্যায্য দামে নিতে সম্মত হন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রেতা বা গ্রাহক গুণগত মানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য কৃষকদের নগদ অর্থ সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ সহায়তা যেমন : সার, বীজ, কীটনাশক, প্রযুক্তি ও পরামর্শ এবং পরিবহন সুবিধা প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে যদি কোনো এক পক্ষ চুক্তির বরখেলাপ করে তাহলে অপরপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এজন্য আমাদের কৃষক ও আগ্রহী গ্রাহকদের সেতুবন্ধ তৈরির জন্য এবং নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একটি মধ্যস্থতাকারী সরকারি কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন, যাতে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হয় বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা। প্রয়োজনীয় সংরক্ষণাগার না থাকায় প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কৃষিপণ্য নষ্ট হয়। আরেকটি বিষয়ে কৃষকদের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, তা হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা। ফলে সেচ সংকটের সৃষ্টি হয়। অপর্যাপ্ত ও ব্যয়বহুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, আরেক দিকে ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় চাষিরা। আমাদের মোটামুটি সুসংহত একটি সড়ক ব্যবস্থা থাকলেও ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি গত ৪০ বছরেও হয়নি। দ্রুত ও নিরাপদ পণ্য পরিবহনে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সময়ের দাবি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য খাতের মতো কৃষিখাতেও ব্যাপক সাফল্য বয়ে এনেছে মোবাইল যোগাযোগ প্রযুক্তি। মোবাইলের মাধ্যমে কৃষি তথ্যসেবা সার্ভিস সচেতন কৃষকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন এবং বাংলালিংক এই সেবা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তবে যথাযথ প্রচারণা ও কৃষকদের অসচেতনতার কারণে এ পদক্ষেপ পুরোপুরি সফল হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। কেননা অনেক কৃষকই এখনও জানে না যে, মোবাইল ফোনে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে কল করেই কৃষি সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি তথ্য সার্ভিস এবং সব মোবাইল অপারেটরকে এগিয়ে আসতে হবে। সব অপারেটরের জন্য একটি অভিন্ন নম্বর এই সার্ভিসের জন্য রাখা এবং সার্ভিসটি বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে দেওয়া যায় কি-না। মোবাইল অন্যভাবে অবশ্য ভালোই সচেতনতা তৈরি করেছে। দালাল ফড়িয়াদের মনগড়া দামে পণ্য বিক্রি না করে সারাদেশে কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্যের বাজারদর জেনে নিতে পারছে। ভোক্তার চাহিদামাফিক দ্রুত পণ্য সরবরাহেও ভূমিকা রাখছে মোবাইল যোগাযোগ।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কৃষি খাত এবং এই খাতের প্রাণ কৃষকদের সমস্যার কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান ত্বরিতগতিতে করা দরকার। সময়মতো বীজ, সার, কীটনাশক ও উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পেঁৗছানোর দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের উচিত মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা সরকারকেই করতে হবে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশের মানুষ বাঁচবে। তাই কৃষির উন্নয়নে, কৃষকের উন্নয়নে যা যা দরকার সবই করতে হবে ত্বরিতগতিতে।

এম আব্দুল মোমিন :গবেষক
momin_sm@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.