তালায় পাঁচ হাজার মানুষ ছয় মাস ধরে পানিবন্দী by কল্যাণ ব্যানার্জি

পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ৯৫০টি পরিবারের পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের এসব মানুষ ছয় মাস ধরে মানবেতর জীব যাপন করছে।
অনেকেই রাস্তার ওপর ছাপরাঘর বেঁধে আছে। যাতায়াতের জন্য সাঁকোর পাশাপাশি নৌকা ব্যবহার করছে। এমনকি মানুষ মারা গেলে কবরও দেওয়া যাচ্ছে না।
মোল্যাপাড়ার মোল্যা আমজাদ হোসেন জানান, কপোতাক্ষ নদ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানিনিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁদের গ্রামের সুপারি, কাঁঠাল, জলপাই, আমড়া, শিমুলসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ মরে যাচ্ছে।
জলাবদ্ধতার ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। তাই তাঁরা গত ৬ নভেম্বর থেকে নিজেরা টাকা তুলে নদ খননের কাজ শুরু করেছেন।
জলাবদ্ধতার কারণে গত মৌসুমে আমন ধান হয়নি। বোরো ধান চাষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এলাকায় কোনো কাজ নেই। মানুষ চর্ম, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছেন। গত রোববার তালা উপজেলার কানাইদিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। উপজেলার জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য সুলতান আহমেদ জানান, এ ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইদিয়া, মোল্যাপাড়া, মীরপাড়া, গাজীপাড়া, সরদারপাড়া, বজনদারপাড়া, কারিগরপাড়া, পালপাড়া, মোড়লপাড়া, শেখপাড়া, দাসপাড়া, হালদারপাড়া, নাথপাড়া, পুড়পাড়ায় এক হাজার ৪০০ পরিবারের সাত হাজার ৪৯৫ মানুষের বাস। এর মধ্যে পাঁচ হাজার মানুষই পানিবন্দী।
গাজীপাড়ার বৃদ্ধ আবদুর সবুর জানান, তাঁর ১২ বিঘা জমি আছে। নিজেই শ্রম দিয়ে ফসল ফলান। সেই ফসল বেচে চলে তাঁর আট সদস্যের পরিবার। কিন্তু কপোতাক্ষ নদ ভরাট হয়ে যাওয়ার পর গত বর্ষা মৌসুমে পানিনিষ্কাশন হতে পারেনি। পুরো কানাইদিয়া গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। ফসলের খেত, বাড়িঘর—সব গত আষাঢ় মাস থেকে তলিয়ে আছে। আমন ফসল ফলাতে পারেননি তাঁরা। চলতি বোরো ফসল করতে না পারলে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
মীরপাড়া গ্রামের রহেলা খাতুন জানান, পানি পচে গেছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে। ছেলেমেয়েদের শরীরে চর্মরোগ হয়েছে, সর্দি-কাশি ছাড়ছে না। পানির মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে এলাকায়। কানাইদিয়া গ্রামের খোদেজা খাতুন জানান, গত ১২ নভেম্বর তাঁর শাশুড়ি সখিনা খাতুন (৭০) মারা গেছেন। পুরো গ্রাম তলিয়ে থাকায় তাঁকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার দরগাপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে কবর দিতে হয়েছে। তিনি আরও জানান, তাঁর প্রতিবেশী মহাতাবকে মহন্দিতে, মরিয়মকে যশোর জেলার রামকণ্ঠপুর গ্রামে এবং লুৎফর রহমানকে কেষ্টকাঠি গ্রামে কবর দেওয়া হয়েছে।
জামালপুর ইউপির চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম জানান, কপোতাক্ষ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষার পানি ও নদের উপচে পড়া পানি আটকে যাওয়ায় ভয়াবহ এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কপোতাক্ষের ভরাট হয়ে যাওয়া অংশের দেড় কিলোমিটার মাটিকাটার যন্ত্র (এস্কাভেটর) দিয়ে খনন শুরু করেছেন তাঁরা। গত ৬ নভেম্বর থেকে এ কাজ শুরু হয়ে এখনো চলছে। এ জন্য প্রতিদিন তেলের খরচ বাবদ সাত হাজার টাকা করে গুনতে হচ্ছে। এই টাকা গ্রামের মানুষই দিচ্ছেন। আরও এক কিলোমিটার কাটতে পারলে হয়তো পানিনিষ্কাশন করা সম্ভব হতো। এ জন্য আরও প্রায় দুই লাখ টাকা দরকার।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘গ্রামের মানুষের কাজ নেই। তাঁরা এত টাকা দেবে কোত্থেকে? ১৫ দিনের মধ্যে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে এলাকার মানুষ বোরো আবাদ করতে পারবে না। তখন এলাকা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।’
তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুর রহমান জানান, বিষয়টি তিনি একাধিকবার পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। আশাব্যঞ্জক কোনো উত্তর না পেয়ে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছেন। মানুষের যাতে সমস্যা না হয়, এ জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পে কাজের ব্যবস্থা করেছেন। যশোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মশিয়ার রহমান জানান, বরাদ্দ না থাকায় তিনি কোনো প্রকল্প নিতে পারছেন না। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নিজেদের উদ্যোগে নদ খনন করতে চাওয়ায় তাঁকে এস্কাভেটর দিয়ে সহযোগিতা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.