বিশ্বজিৎ হত্যার দায় নেবে কে? by ড. তুলসী কুমার দাস

মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিরপরাধ বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের রাজপথ অবরোধ কর্মসূচির দিনে দুর্বৃত্তরা খুন করল বিশ্বজিৎকে। ঠাণ্ডা মাথার খুন। অবলীলায় কুপিয়ে কুপিয়ে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠল একদল খুনি।
রক্তে ভিজে যাওয়া শরীরটাকে টেনে নিয়ে নিজেকে বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন বিশ্বজিৎ। কিন্তু পারলেন না। নরপিশাচরা তাঁকে ঘিরে ধরল, রক্তের নেশায় উন্মত্ত খুনিরা চাপাতি দিয়ে তাঁকে কোপাল; লোহার রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করল। প্রাণবন্ত যুবক বিশ্বজিৎ অসহায়ের মতো মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটছট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। একি মৃত্যু? এই খুনের জন্য দায়ী কে?
ক্ষমতাসীনরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই খুনের দায় নেবে না। হরতালকারীরা নিশ্চয়ই একই কথা বলবে। হরতালকারী ও হরতালবিরোধী উভয়ই দেশের কল্যাণ বলতে অজ্ঞান! দেশের কল্যাণের জন্যই তো তারা হরতাল ডাকছে, হরতালের বিরোধিতা করছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া তো দেশের কল্যাণ ও মঙ্গল নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই তো হরতাল ডাকা বা হরতালের বিরোধিতা করা। দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য দু-একজন বিশ্বজিতের প্রাণ গেলে তাতে কী এসে যায়? সামনে আরো হরতাল ...! হরতালবিরোধীরাও প্রস্তুত। হিংসার লেলিহান শিখায় আরো কত বিশ্বজিতের বুকের তাজা রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধূলিকণাকে লাল করে দেবে তা আমরা কেউই জানি না। শুধু জানি এই নৃশংসতা, এই নির্মমতা দরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ... রাষ্ট্রীয় কল্যাণ ... এবং গণতন্ত্র (প্রকৃত!) প্রতিষ্ঠার জন্য! হায় বিশ্বজিৎ! রক্তে ভিজে যাওয়া আপনার শার্ট, রক্তে ভিজে যাওয়া আপনার সারা শরীর আমাদের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে না। আমাদের বিদ্রোহী করে তোলে না!
এসব আর কত দিন চলবে? মানুষকে বোকা বানানোর রাজনীতি; মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার রাজনীতি বাংলাদেশ কি সহ্য করবে? আমাদের ইতিহাস কী বলে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ? রক্তে কেনা স্বাধীনতা? লাখ লাখ মানুষের আ@ে@@@াৎসর্গ? বাংলাদেশ কিন্তু জেগে উঠবেই! রুখে দাঁড়াবেই। জানি না আর কত বিশ্বজিৎকে সে জন্য লাশ হতে হবে?
টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বজিতের খুনিদের পাশবিকতা দেখেছে সারা দেশ। দেশবাসী জানে, বিশ্বজিতের খুনি কারা? এরা নাকি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। এদেরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই? আমরা কী শেখাই তাদের? জনগণের ট্যাঙ্ েচলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই খুনিরাও পড়ে। অনায়াসে ঢুকে যায় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোতে; কর্মী হয়, নেতা হয়। সন্ত্রাস করে, খুন করে। আমরা না দেখার ভান করি। শাস্তি দিতে পারি না। কোনো কোনো সময় ভয়ে, আবার কখনো আত্মস্বার্থে। রাজনীতির কারণে তাদের ব্যবহারও করা হয়। সে কারণে তারা যাতে ধরা না পড়ে, শাস্তি না পায়_সেটাও দেখতে হয় বৈকি। তাই তো বিশ্বজিৎরা বারবার খুন হয়। কিন্তু খুনিদের পাওয়া যায় না। তাহলে বিশ্বজিৎ খুনের দায় কে নেবে বলুন?
আমরা এখন কী করব? হাল ছেড়ে দেব? সরকারের কঠোর মনোভাবের ওপর আস্থা রাখব? নাকি সেই চিরাচরিত ব্যর্থতা! ক্রমেই ভুলে যাওয়া, সয়ে যাওয়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঙ্কার কি আমাদের একটুখানি আশাবাদী করে? তিনি কি এবার সত্যিই প্রমাণ করবেন_'যত গর্জে তত বর্ষে না' প্রবাদটি ভুল; তাঁর জন্য একেবারেই প্রযোজ্য নয়। খুনিদের তিনি আইনে সোপর্দ করতে বদ্ধপরিকর। দেশবাসী কিন্তু অধীর আগ্রহে সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা লোকদেখানো নয়। সত্যিকারের খুনিদের গ্রেপ্তার করুন। মানুষের ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। অনুগ্রহপূর্বক আর হতাশ করবেন না।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.