পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ-বিশেষজ্ঞদলের মতামতের দিকে তাকিয়ে সরকার

পরামর্শক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা দায়েরের পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এখন নির্ভর করছে ঢাকা ঘুরে যাওয়া বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মূল্যায়নের ওপর। সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছেন।
একই দিনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ব্যাপারে আবারও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, মামলা দায়েরসহ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পদক্ষেপ পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মূল্যায়ন দেবে তার ওপর নির্ভর করবে সংস্থাটির অর্থায়নের সিদ্ধান্ত। গতকাল এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, দুদকের তদন্তের পর্যাপ্ততা এবং দায়ের করা মামলার নথি পর্যালোচনা করার পর প্রতিবেদন দেবে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। তারা মামলার এজাহার নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করবে। সার্বিক পর্যালোচনার পরই তারা একটি প্রতিবেদন দেবে। বিশ্বব্যাংক ভবিষ্যতে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে কি না এবং বাস্তবায়নের সঙ্গে থাকবে কি না তা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মূল্যায়নের (প্রতিবেদন) ওপর নির্ভর করবে।
এদিকে দুদকের মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। বনানী থানায় সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার সাত আসামির মধ্যে তিনিও একজন। মামলার তদন্তের জন্য গতকাল চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে দুদক। ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে এই তদন্ত দলের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান আইনজীবী লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুদকের তদন্ত পর্যবেক্ষণে দুদফা ঢাকা সফরে আসে। গত ১৪ অক্টোবর প্রথম এবং গত ১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় তাঁরা ঢাকা সফর করেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় দুদকের সঙ্গে বৈঠকে কোনো ধরনের মতানৈক্য হয়নি। সমঝোতা ছাড়াই ৫ ডিসেম্বর তারা ঢাকা ত্যাগ করেন। দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মামলা দায়েরসহ প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী আশাবাদী : অর্থমন্ত্রী গতকাল বলেছেন, 'বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেই দুদক মামলা করেছে। মামলার বিষয়টি বিশ্বব্যাংককে জানানো হয়েছে। এখন তারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবে।' বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করেই দুদক সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ব্যাপারে আশাবাদী কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি আশাবাদী।'
দুদকের মামলায় সাবেক দুই মন্ত্রীকে আসামি না করায় পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে- গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের এমন সমালোচনার জবাবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, 'বিশেষজ্ঞরাই দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাদের চোখে দেশের কোনো উন্নয়নই হয়নি।'
সাবেক সেতু সচিব ওএসডি : দুদক মামলা করার দিনই সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে তাঁকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল। তারও আগে সেতু বিভাগ থেকে সরিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে বদলি করা হয়েছিল। এখন ওই পদ থেকে সরিয়ে ওএসডি করে তাঁকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
গত সোমবার মোশাররফকে ওএসডি করার এই আদেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দুদকের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কানাডীয় কম্পানি এসএনসি লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য অর্থ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রথম আসামি করা হয়েছে।
মামলার তদন্তে চার সদস্যের কমিটি : মামলা তদন্তে দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদকে প্রধান করে গঠিত দলের অন্য সদস্যরা হলেন মীর মো. জয়নাল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও মির্জা জাহিদুল আলম। এই দলের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবেন দুদকের পরিচালক মনিরুজ্জামান। নিয়ম অনুযায়ী ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত ১৫ দিন সময় দেওয়ার বিধান রয়েছে।
গত সোমবার পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আবদুল্লাহ আল জাহিদ বাদী হয়ে দুদকের পক্ষে মামলাটি করেন। খসড়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সুপারিশে নাম থাকলেও মামলা করা হয় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে বাদ দিয়ে। সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া ছাড়াও মামলার বাকি ছয় আসামি হলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালিস, রমেশ সাহা, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক পরিচালক মো. ইসমাইল এবং এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশের লোকাল এজেন্ট ইপিসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফা।
এদিকে দুদকের করা মামলা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টিতে কিছু যায় আসে না বলে মন্তব্য করেছেন দুদক সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী। গতকাল দুদক কার্যালয়ে মাসিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে দুদকের করা মামলায় বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হবে কি না, সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদক যাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাংকের সন্তুষ্ট-অসন্তুষ্ট হওয়া নিয়ে কিছু যায় আসে না। তিনি আরো বলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে কারো সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ওপর মামলা নির্ভর করে না। দুদকের কাছে যেসব তথ্যপ্রমাণ ছিল তার ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে। দুদকের তদন্তে যদি আরো কারো বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাদেরও মামলায় আসামি করার সুযোগ এখনো আছে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া মামলা করলে আদালতে মোকাবিলা করা যাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.