রংপুর সিটি নির্বাচন-প্রচারণার শেষ দিনে রাজনৈতিক উত্তাপ

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে 'রাজনৈতিক উত্তাপ' ছড়িয়েছে কাল। নবগঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিন ছিল গতকাল মঙ্গলবার। ওই দিন পর্যন্ত 'রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত' রসিক নির্বাচনে হঠাৎ রাজনৈতিক উত্তাপ সঞ্চার করে জাতীয় পার্টির সংবাদ সম্মেলন।
রসিক নির্বাচনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত মনে হলেও বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতারা কালের কণ্ঠকে বলেন, কে কোন দলের প্রার্থী, কাকে বিজয়ী করলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে- রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা গতকাল থেকে এ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও শুরু হয়েছে জোরেশোরে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পরিচয়, যোগ্যতা-দক্ষতা এবং কে নগরপিতার চেয়ারে মাননসই হবেন- শেষ মুহূর্তে এসব ভাবতে শুরু করেছে নগরবাসী।
প্রার্থী এক ডজন হলেও মূলত তিনজনকে ঘিরেই হিসাব কষছে রংপুরবাসী। তাঁরা হলেন শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু (উপদেষ্টা, জেলা আওয়ামী লীগ), মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা (জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা) এবং এ কে এম আবদুর রউফ মানিক (জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা)। ঝন্টু অঙ্গীকার করেছেন, তিনি গ্যাস আনবেন, মানিক গড়তে চান আধুনিক নগর, আর নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে চান মোস্তফা।
এদিকে নির্বাচনের মাত্র এক দিন আগে স্থানীয় জাতীয় পার্টির নাটকীয় সংবাদ সম্মেলন নির্বাচনে রাজনৈতিক উত্তাপের সৃষ্টি করে। চায়ের দোকান, পাড়া-মহল্লা সর্বত্র একই আলোচনা- কেন এই সংবাদ সম্মেলন। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সরাসরি বিরোধিতা করে দলীয় নেতা-কর্মীদের তাঁকে ভোট না দিতে নির্দেশ দেন। এতে রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীসহ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ভোটারদের মধ্যে প্রশ্ন- প্রচারণার শেষ দিনে জাতীয় পার্টির এ কোন খেলা?
সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙ্গা তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করতে শেষ বেলায় মোস্তফার বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলন করেন। মোস্তফা বিজয়ী হলে এলাকায় তাঁর রাজনীতি হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন রাঙ্গা; তাই এ কৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নাটকীয় এই সংবাদ সম্মেলন হয়েছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।
হাঁস মার্কা নিয়ে মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গার উত্থাপিত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমার নির্বাচনী জোয়ার দেখে রাঙ্গা শঙ্কিত হয়ে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। কারণ আমি মেয়র নির্বাচিত হলে রাঙ্গার রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। ঠিক ভোটের আগমুহূর্তে এসব ভুঁইফোড় নেতার কথা রংপুরের সাধারণ মানুষ আমলে নেবে না। তারা আমাকে ভালোবাসে। জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী আমি।'
গতকাল প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন মেয়র প্রার্থীদের সবাই। কর্মী-সমর্থকরাও মাইক নিয়ে প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। প্রার্থীরা রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার রংপুরবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নগরপিতার দায়িত্ব একজনকে দেবেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত জয়ের আশাতেই আছেন সব প্রার্থী।
গতকাল বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও অন্য প্রচার সামগ্রীতে ছেয়ে গেছে গোটা নির্বাচনী এলাকা। প্রার্থীর সমর্থনে শোডাউন করেছে সমর্থকরা।
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা মঙ্গলবার মধ্য রাতে শেষ হয়েছে। কাল বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ। প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল প্রার্থীরা দিনভর ছুটেছেন নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে গোটা সিটি এলাকাকে। নির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থীর সেনা মোতায়েনের দাবি থাকলেও ইসি তা নাকচ করে দিয়েছে। গতকাল সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
জাতীয় পার্টির সংবাদ সম্মেলন
মেয়র পদে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাকে ভোট না দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন রংপুর মহানগর ও জেলা জাতীয় পার্টির নেতারা। দুপুরে জাতীয় পার্টির জেলা কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টেলিকনফারেন্সে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন কাদেরী।
টেলিকনফারেন্সে এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে কাউকে সমর্থন দেয়নি। কেউ যদি সমর্থন দেওয়ার দাবি করে তা হলে সেটি হবে মিথ্যা। দলের সমর্থন বিষয়ে উড়ো খবরে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, 'এটা জাতীয় নির্বাচন নয়। পার্টি কাউকে সমর্থন দিয়ে থাকে। আমি মসিউর রহমান রাঙ্গাকে সমর্থন করেছিলাম, কিন্তু আরো দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় বিজয় কঠিন হতো। সে কারণে আমরা সরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের কারো প্রতি সমর্থন নেই। তবে মোস্তফা ছাড়া আর কাউকে ভোট দিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।'
মোস্তফার নির্বাচনী কাজে কেউ সহযোগিতা করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণাও দেন এরশাদ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা, জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবুল মাসুদ চৌধুরী নাণ্টু, জেলা যুব সংহতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।
লড়াই হবে হড্ডাহাড্ডি
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে উৎসবের আমেজে পুরো নগরী। রংপুরবাসীর প্রথম মেয়র কে হচ্ছেন সে আলোচনাই সবার মুখে। ঝণ্টু-মোস্তফা-মানিকের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে ভোট বিশ্লেষকরা মনে করেন; নগরবাসীর ধারণাও তা-ই।
আগামীকাল নির্বাচন। এর মধ্যে ১১নং ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। মোট ভোটার তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ জন। এর মধ্যে এক লাখ ৭৯ হাজার ১২৮ পুরুষ এবং এক লাখ ৭৮ হাজার ৬১৪ জন মহিলা ভোটার। মেয়র পদের জন্য ১২ জন, ৩৩টি সাধারণ কাউন্সিলর পদের জন্য ৩২৭ জন এবং ১১ জন মহিলা কাউন্সিলর পদের জন্য ৯১ জন_মোট ৪৩০ জন প্রার্থী হয়েছেন।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় এবং ভোট বিশ্লেষকদের কথায় বেরিয়ে এসেছে, নির্বাচনে লড়াই হবে ত্রিমুখী। লড়াইয়ে আছেন এ কে এম আবদুর রউফ মানিক, শরফুদ্দিন আহমেদ ঝণ্টু এবং মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। অনেকেই আবার বলছেন ভোটযুদ্ধ হবে দ্বিমুখী। এ ক্ষেত্রে কেউ মানিক-মোস্তফা, কেউ মোস্তফা-ঝণ্টু, আবার কেউ মানিক-ঝণ্টু লড়াইয়ের কথা বলছেন।
জনমত জরিপ থেকে জানা গেছে, ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে মানিক, ১২টিতে ঝণ্টু, ছয়টিতে মোস্তফা এবং দুটি ওয়ার্ডে আনারস প্রতীক প্রথম হতে পারে। ১২টিতে মানিক, ১১টিতে ঝণ্টু এবং আটটিতে মোস্তফা দ্বিতীয় হতে পারেন। এ ছাড়া মানিক সাতটি, ঝণ্টু আটটি এবং মোস্তফা ১৮টিতে তৃতীয় হতে পারেন। তাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় যা-ই হোন ভোটের ব্যবধান হবে অনেক কম। অর্থাৎ তিন প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।
নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা রংপুর
রংপুর অফিস জানিয়েছে, আগামীকালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে রংপুর মহানগর। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নগরীর ২০৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। কেন্দ্রগুলোর ৪০০ গজের মধ্যে চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শহরে যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে সোমবার রাতেই। সব প্রস্তুতি শেষ, রাত পোহালেই নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হবে।
রংপুরের পুলিশ সুপার ও কোতোয়ালি থানার ওসি জানিয়েছেন, নির্বাচনে নিয়োজিত থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য। সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান চলেছে।
পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ভোটের দিন কেন্দ্রগুলোতে অস্ত্রধারী আনসার সদস্য ছাড়াও পুলিশ থাকবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করবে একটি মোবাইল ফোর্স। সিটিকে চারটি জোনে ভাগ করে পুলিশের সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য ও র‌্যাবের সমন্বয়ে বিশেষ ফোর্স নিয়োজিত রাখা হবে। এ ছাড়া পুলিশ লাইনে রিজার্ভ ফোর্স মোতায়েন থাকবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।
ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি শেষ
রংপুর অফিস আরো জানিয়েছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আজ বুধবারের মধ্যে নির্বাচনী সরঞ্জাম সব কেন্দ্রে পাঠানো হবে। গতকাল মঙ্গলবার রংপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
আঞ্চলিক নির্বাচনী কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার মনিরুল ইসলাম জানান, সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ভোট কেন্দ্র ১৭৮টি, বুথের সংখ্যা এক হাজার ৭০টি। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবেন ২০০ প্রিসাইডিং অফিসার, এক হাজার ১০০ সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও দুই হাজার ২০০ জন পোলিং অফিসার।

No comments

Powered by Blogger.