গ্রাম দেখতে বাংলাদেশে by জাহিদ হোসাইন খান

যেকোনো তাত্ত্বিক পড়াশোনার জন্য ব্যবহারিক শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে ব্যবহারিক শিক্ষার আগ্রহ এখনো সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে। কিন্তু সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ থেকে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে আসেন পড়াশোনার কাজে, গবেষণা করতে।
বইপত্রের জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জীবন মিলিয়ে দেখতে চলে আসে বাংলাদেশে। সম্প্রতি আমাদের দেশে দুই সপ্তাহ থেকে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্লেটন কলেজের ১৬ জন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী। অর্থনীতি নিয়ে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ সফরের দিকনির্দেশক ছিলেন কার্লেটন কলেজের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অধ্যাপক মুহাম্মদ ফারেস ভূইয়া।
জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ সুদৃঢ়। মার্কিন শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অবস্থান, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড নিয়ে। ১০ ডিসেম্বর সকালে তাঁদের পাওয়া গেল রাজধানী ঢাকার আফতাবনগরের একটি সূর্যের হাসি চিহ্নিত কমিউনিটি ক্লিনিকে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক দাতা সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত এই ক্লিনিকে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিলেন বিদেশি এই শিক্ষার্থীরা। শহরের মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে এমন সেবা প্রকল্প দেখে শিক্ষার্থীরা বেশ অবাকই হন। বড় বড় হাসপাতালে না গিয়ে মানুষ চলে আসে এসব ক্লিনিকে। যেখানে সবাই কম খরচে তাদের সব চিকিৎসাসেবাই পায়। ক্লিনিকে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। টেলিভিশনের পর্দায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে নানা বিজ্ঞাপন, নাটক, ভাষা জটিলতায় বুঝতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু ক্লিনিকে আগত মানুষের টিভির প্রতি আগ্রহ দেখে সবাই তার গুরুত্ব ঠিকই বুঝেছিল। ভাঙা বাংলায় ‘ধন্যবাদ’ বলে ক্লিনিকের রোগীদের বেশ অবাকই করে দেন অনেকে।
চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিনি সুচাও ওয়াংয়ের বাংলাদেশ সম্পর্কে আগে তেমন ধারণা না থাকলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পরিশ্রম করার মানসিকতা ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই অবস্থান করছে। সুচাও বাংলাদেশের মানুষের পরিশ্রমের প্রশংসা করে বলেন,‘অচিরেই এ অবস্থার বদল হতে পারে। চীনের পোশাক রপ্তানির গুণগত মান বাংলাদেশের সমান এবং চীনা শ্রমবাজারের থেকে সস্তা শ্রমবাজারের জন্য বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে।’ চীনে রিকশার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশের রিকশায় চড়ে ভীষণ মজা পেয়েছেন বলে জানান সুচাও।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়ছেন পাকিস্তানের সানা রফিক। দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনের বৈচিত্র্যের ওপর জোর দেন তিনি। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সামাজিক অর্থনৈতিক সমস্যা একই ধরনের। এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অগ্রগতি অন্যান্য দেশ অনুসরণ করতে পারে। নারী উন্নয়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে বলে মনে করেন মার্কিন এই শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের খাবারের বৈচিত্র্য সানাকে আকৃষ্ট করলেও ঝাল মরিচের কারণে অনেক খাবার তার চোখে জল এনে দিয়েছিল।
দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ম্যাট কটার বাংলাদেশ সম্পর্কে স্কুলে বইপত্রে খুব একটা পড়েননি। কিন্তু কলেজের বই থেকে জেনেছেন, ‘পৃথিবীতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণের আঁতুড়ঘর।’ ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্যকে জয় করার সংগ্রামে মুগ্ধ ম্যাট। দেশে গিয়ে বন্ধুদের বাংলাদেশের গ্রাম ঘুরে যাওয়ার জন্য বলবেন। ঢাকার রিকশা এবং দুপুরের খাবারের সময় ‘ডাল’-এর পাঁড় ভক্ত হয়ে গেছেন ম্যাট।
বাংলাদেশে দুই সপ্তাহ ভ্রমণে এই ১৬ শিক্ষার্থী বগুড়া-খুলনার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে এসেছেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতি বিতর্ক আয়োজনেও অংশ নেন এই শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ তাঁরা। বাংলাদেশে এসে এই শিক্ষার্থীরা ক্রিকেট খেলা কী, তা চিনেছেন। বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেট-ম্যানিয়া দেখে সবাই অবাক। বাংলাদেশ-উইন্ডিজের ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য সবাই হাজির হয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। কিন্তু টিকিট না পাওয়ার জন্য হোটেলের টেলিভিশনেই সবার সঙ্গে বাংলাদেশের বিজয় উদ্যাপন করেছেন এই বিদেশিরা। বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় কী নিয়ে যাবেন, এ প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলেছেন, বাংলাদেশে আসার অভিজ্ঞতা, নকশিকাঁথা, নানা রঙের মোমবাতি আর মাটির পুতুল নিয়ে যাবেন দেশে। অনেকে আবার জোর দিলেন, একটা ক্যারম বোর্ডও নিয়ে যাবেন। কারণ বাংলাদেশে এসে প্রতিদিনই সবাই ক্যারম খেলেছেন দল বেঁধে। ক্যারম বোর্ডের সাদা পাউডারের মতো বাংলাদেশের মানুষের সাদা মন দেখে সবাই মুগ্ধ। তাই সবাই আবারও আসতে চান বাংলাদেশের গ্রামে।

No comments

Powered by Blogger.