ক্ষমতাধরদের সেবায় ১০১ গাড়িঃ এলজিইডির গাড়ি কি গনিমতের মাল

যাদের জন্য দরকার, তারা গাড়ির অভাবে বসে আছেন হাত-পা গুটিয়ে। প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে যেতে পারছেন না। একান্ত বাধ্য হলে পরিদর্শনে যাচ্ছেন হেঁটে অথবা কারও মোটরসাইকেলের পেছনে বসে। যাদের দরকার নেই, তারা ক্ষমতার জোরে বগলদাবা করেছেন এলজিইডির শতাধিক গাড়ি। এ গাড়ি ভোগদখলকারীদের মধ্যে মন্ত্রী থেকে সচিবালয়ের পিও পর্যন্ত সবাই আছেন।
আছেন এমপি, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আমলা। এমনকি সরকার সমর্থক একজন বুদ্ধিজীবীও আছেন এ ভোগদখলদারদের তালিকায়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে ওইসব ব্যক্তিকে গাড়ি সরবরাহ করতে বাধ্য করেছে এলজিইডিকে। মন্ত্রণালয়ের পিও মনের আনন্দে এলজিইডির গাড়িতে করে রাজধানীর ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের আত্মীয়-স্বজন নিজের মনে করে এলজিইডির গাড়িতে ঘুরে ঘুরে তেল ফুরাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতার মাধ্যমে অপব্যবহৃত গাড়ির মোট সংখ্যা ১০১টি। গাড়িগুলোও খুবই দামি—টয়োটা, টয়োটা ভিএক্স এবং টয়োটা প্রাডো। আমার দেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রকল্পের পিপি অনুযায়ী জেলা পর্যায়ে প্রকল্পের কাজে গাড়িগুলো বরাদ্দের কথা থাকলেও সরকারের বিভিন্ন লেভেলের লোকজনকে খুশি করতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার গণহারে গাড়ি বরাদ্দ দিচ্ছেন। যুক্তির কথা যাই হোক, এলজিইডির কর্তারা বলছেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের গাড়ি দিতে যদি সরকার বলে, তাহলে আমরা দিতে বাধ্য। একই যুক্তি দেখানো হচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের গাড়ি ভোগদখল প্রসঙ্গে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এলজিইডির গাড়ি যেন গনিমতের মালামাল। যার যখন যেমন ইচ্ছে, তখনই তা নিয়ে যেতে পারেন। নইলে ক্ষমতার প্রতাপে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এতগুলো গাড়ি কর্তাদের খায়েশমতো এভাবে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে পারত না। আবার শুধু যে গাড়িই তারা দখল করছেন তা নয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় করছেন তেল, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, এমনকি ড্রাইভারের বেতনও। এ খাতে বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, খোদ মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজের ব্যবহারের জন্য নিয়েছেন একটি নয়, দুটি গাড়ি। রাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিয়েছেন একটি গাড়ি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম নিয়েছেন তিন-তিনটি গাড়ি। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকও নিয়েছেন তিনটি গাড়ি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যিনি জাতিকে অষ্টপ্রহর নানা বিষয়ে নসিহত করেন, তিনিও বাগিয়ে নিয়েছেন একটি গাড়ি। আবার তিনি না থাকলে সেই গাড়ি যাতে তার শিষ্য-সাগরেদরা ব্যবহার করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও পাক্কা। এ গাড়িগুলোর খাতে যে ৯ কোটি টাকা বছরে খরচ হয়, সে টাকা অঘোষিতভাবে আদায় করা হয় প্রজেক্টগুলো থেকে। এ বাড়তি অর্থের জোগান দেয়ার জন্যই চলছে মুষলধারে অনিয়ম এবং দুর্নীতি।
এলজিইডির গাড়ি যে ইতিহাসে এবারই প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যায্য খাতে তা হয়তো নয়। এর আগেও মন্ত্রী-সচিবরা কারণে-অকারণে ব্যক্তিগত কেরদানি ফলানোর জন্য এলজিইডির গাড়ি ব্যবহার করেছেন। তারপরও সেই ব্যবহারের একটা ছিরিছাদ ছিল। একটা চক্ষুলজ্জা ছিল। এবার সেই ছিরিছাদ, চক্ষুলজ্জার শেষ চিহ্নটুকুও যেন মুছে গেছে। গণহারে গনিমতের মালের মতো এলজিইডির গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ দরকার পড়লে দু’একদিনের জন্য গাড়ি নেয়ার মধ্যে দোষ থাকলেও, বড় ধরনের অপরাধ হয়তো তা নয়। কিন্তু প্রজেক্টের কাজ বন্ধ করে, প্রজেক্টকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে ঠেলে দিয়ে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিও, এপিএস আত্মীয়-স্বজন, শিষ্য-সাগরেদরা হা হা করে বীরদর্পে—গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াবেন—এ তো তোগলকি কাণ্ডের মধ্যে পড়ে।
আমরা সবসময়ই প্রত্যাশা করি আইনের শাসন। নিয়মনীতির মধ্যে চলাই তো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নাগরিকের লক্ষণ। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, বিধিবিধান, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব যে কর্মসূচি, সেসব যথার্থভাবে মেনে চললেই ক্ষমতান্ধরা বেশি সুযোগ নিতে পারে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির বড় কর্তারাও যাতে আগ বাড়িয়ে কদমবুচি করতে না যান। এ অপব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার কোনো বিচার হবে কিনা জানি না—হলে দেশের মঙ্গল হবে।

No comments

Powered by Blogger.