বাংলাদেশের নারীর সংগ্রামের কথা বারবারই উঠে আসে by শিখতী সানী

চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর অ্যাট-লার্জ ফর গ্লোবাল উইমেন্স ইস্যু মেলান ভারভিয়ার। ১৯৯৫ সালে এসেছিলেন তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে।
এবার এসেছিলেন ৮ থেকে ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া নারী উদ্যোক্তা সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কিরগিজস্তান ও কাজাখস্তান থেকে প্রায় ১২০ জন নারী উদ্যোক্তা এবং অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছেন এই সিম্পোজিয়ামে। মেলান ভারভিয়ারের সঙ্গে কথা হয় ৯ ডিসেম্বর হোটেল রূপসী বাংলায় সমকালীন বিভিন্ন প্রতিকূলতায় নারী, উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁদের সংগ্রাম এবং তাঁদের উত্তরণের কথা নিয়ে।

 এ অঞ্চলের নারীদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
 পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীদের নিয়ে আলোচনায় সব সময়ই বাংলাদেশের নারীর সংগ্রাম এবং উত্তরণের কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁদের প্রশংসনীয় অবদান থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক অধিকার, উত্তরাধিকার এবং সম্পত্তি আইনে তাঁরা বৈষম্যের শিকার। সরকারের উচিত এই আইনগুলোকে এমনভাবে পর্যালোচনা করা, যাতে বিপদের সময় অসহায় নারীরা লড়াই করে টিকতে পারেন।
বাল্যবিবাহ রোধে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নারীবিষয়ক কার্যালয়’ একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ক্ষুদ্র আকারে তারই একটি পাইলট প্রকল্প এই বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হবে। আমরা সামনে আরও একটি প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাব, যাকে বলছি ‘ইক্যুয়াল ফিউচার’। যাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একাত্ম ঘোষণা করেছেন।
 ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসা ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা সাধারণত কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন?
 বিশ্বের যেকোনো দেশের নারীকে একই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। নারী উদ্যোক্তারা চান তাঁদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য বাজার ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। ভারতে ‘সেলফ এমপ্লয়েড উইমেন অ্যাসোসিয়েশন (এসইডব্লিওএ)’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যা ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত নারীদের পণ্যগুলো বিক্রয়ের ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে সহযোগিতা করে। নারী উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ এবং একজন নির্ভরযোগ্য প্রশিক্ষক, যিনি তাঁদের ব্যবসাসংক্রান্ত জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল বলে দেবেন।
 সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা যেমন প্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, একই সঙ্গে নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাও বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ‘অফিস অব গ্লোবাল উইমেন্স ইস্যুজ’ এ ধরনের সহিংসতা রোধে কী কাজ করছে?
 নারীর উন্নয়নের পাশাপাশি, নারীর প্রতি সহিংসতাকে আমরা সব সময়ই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছি। সারা পৃথিবীতে নারীর প্রতি সহিংসতা ছড়িয়ে আছে মহামারির মতো। আমরা এই সিম্পোজিয়ামেও এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি।
একদিকে নারীরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছেন, তেমনিভাবে বাড়ছে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাও। নারীর যেখানে সম্মান নেই, কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নেই, সেখানে তিনি কীভাবে এগিয়ে যাবেন?
সহিংসতা নারী বা পুরুষ কারও জীবনের অংশ হতে পারে না। সমাজে নারীদের প্রতি আমাদের বৈষম্যমূলক আচরণ, আইন, রীতিনীতি এবং ধর্মীয় বিধান নারীর সফলতাকে বাধা দেয়, প্রতিহত করে। আরও আছে নারীর সুস্থতার বিষয়টি। সমাজে নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে কথা বলতে হবে।
আমরা সিম্পোজিয়াম চলাকালে পোশাকশিল্পে নিয়োজিত মালিক, শ্রমিক এবং বিদেশি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। বিদেশি বিক্রেতাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। পোশাকশিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু তাঁরা কি আসলেই নিরাপদ? বিদেশি বিক্রেতারা কিন্তু ভালোভাবেই জানেন, যেখান থেকে তাঁরা পণ্য কিনছেন, সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা লিঙ্গবৈষম্যের নজির পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাঁদের ব্র্যান্ড।
কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে চলছে কি না সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
নারী শ্রমিকদেরও জোট হতে হবে, সচেতন থাকতে হবে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে। সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, যাতে বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে সবাই ‘উইন-উইন’ অবস্থা পেতে পারেন।
 জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা এগিয়ে থাকলেও এই অঞ্চলে নারী অধিকার সহায়ক আইন, রীতিনীতি ও আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। কমেনি সহিংসতা। তাহলে কি নারী ক্ষমতায়নের ধারণার ভুল পথে এগোচ্ছি আমরা?
 এটি আসলেই ঠিক। জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে নারীর ভূমিকা থাকলেও সমাজে নারীর অবস্থানের তেমন পরিবর্তন আসছে না। পারিবারিক, সম্পত্তি, অধিকারমূলক আইনে নারী প্রাধান্য পাচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী সেক্রেটারি অব স্টেট মেডলিন অলব্রাইট একবার বলেছিলেন, তারা নিকৃষ্ট, যারা শিখরে উঠে অন্যদের ওপরে ওঠার মইটা সরিয়ে রাখে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সবাই তেমনভাবে চিন্তা করেন না।
এই সিম্পোজিয়ামে অংশ নেওয়া নারী উদ্যোক্তারা ফিরে গিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতাকে শেয়ার করবেন অন্য নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। সবাইকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নেটওয়ার্কিং প্রসারিত করবেন। একসঙ্গে অনেক নারীর একত্রে কাজ করার প্রেরণায় নারী ক্ষমতায়নের এই সমস্যাকে দূর করবে।
বৃহৎ আকারে সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষশাসিত নেতৃত্বে নারীর বাধাধরা এই ভাবমূর্তিকে বদলে দেবে। আমরা স্বপ্ন দেখি এই বদলের।

No comments

Powered by Blogger.