সেই মহান ব্যক্তির প্রত্যাশায় আছি by আতাউস সামাদ

বছর দেড়েক আগে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় একটি ধানক্ষেতে পড়ে থাকা প্রাণহীন এক নারীর ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। কমলগঞ্জের এস কে দাসের প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপানো ওই ফটোগ্রাফে আরও দেখা যাচ্ছিল যে তার শিশুসন্তান মায়ের বুকের দুধ পাওয়ার জন্য মৃতদেহের পাশে বসে কাঁদছে। ওই হতভাগ্য মা’র নাম ছিল রুবি।
শিশু মেয়ের নাম জলি। রুবিকে কে বা কারা হত্যা করে তার স্বামীর গ্রামের পাশে ধানক্ষেতে ফেলে রেখে গিয়েছিল। নিহত হওয়ার সময় তার শিশুকন্যা তার সঙ্গে ছিল। যিনি রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন তা থেকে জানা গিয়েছিল রুবির স্বামী প্রবাসে কর্মরত। বিদেশ থেকে তিনি সংসারের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠান। সেই টাকা থেকে কিছু স্বামীর পক্ষের এক আত্মীয়কে জমি কেনার জন্য দিয়েছিলেন রুবি। সেই টাকা ফেরত চাওয়াই তার প্রাণনাশের কারণ কিনা তা তখনও স্পষ্ট ছিল না, তবে তদন্তের একটা সম্ভাব্য বিষয় ছিল সেটা। ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেষ পর্যন্ত কাউকে নিশ্চিতভাবে দায়ী করা গিয়েছিল কিনা, আর তা হয়ে থাকলেও হত্যার বিচার শেষ হয়েছে কিনা খবরের কাগজের পাতায় তা চোখে পড়েনি। এই মাত্র জানলাম ওই মামলার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। এটুকু মনে পড়ছে যে, ওই ছবি ও খবর সেই সময় দৈনিক আমার দেশ, সাপ্তাহিক এখন এবং চ্যানেল আই ছাড়া অন্য কোথাও তেমন কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেনি। করতে পারলে ভালো হতো। কারণ, ওইরকম ঘটনা নিয়ে ও সেগুলোর তদন্তে কী উন্মোচিত হচ্ছে সেসব নিয়ে মানুষ সজাগ থাকলে এবং আলোচনা করলে দেশের অপরাধপ্রবণতার গতি-প্রকৃতি সবার কাছে পরিষ্কার থাকত। সরকারও তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়তোবা উদ্যোগী হতো।
অবশ্য সরকারের কাজটা নির্ভর করে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। কারণ, বাংলাদেশে কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করা হবে কিনা সেটা নির্ভর করে সেই অপরাধীর সঙ্গে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের লোকদের সম্পর্ক কী তার ওপর। এমন বারবার দেখা গেছে যে, সরকার যদি মনে করেছে কোনো ক্রিমিন্যাল তার বন্ধু তাহলে পুলিশ তার কেশাগ্র স্পর্শ করেনি। তাকে দেখা গেছে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের সংবর্ধনা মঞ্চে। কোনো কোনো নেতা তো মফস্বল শহরে বেড়াতে গিয়ে দাগি অপরাধীর বাড়িতেই অতিথি হিসেবে উঠেছেন। জনগণ যদি এই সমাজ-বিরোধীদের ব্যাপারে বেশি বিরক্ত হয়েছে, তো তাদের কাউকে কাউকে পাঁচ-ছয় মাস জেলে রেখে তারপর জামিনে ছেড়ে দেয়ার পর তার মামলা স্মৃতি-বিলুপ্ত অবস্থায় চলে গেছে। সেই দুর্বৃত্ত এর কিছু দিনের ভেতরেই সরকারি দলের কোনো না কোনো জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আবার কেউ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে আমাদের দয়া দেখিয়ে বিদেশে চলে গেছে।
আবার কোনো অপরাধী বা সন্ত্রাসী যদি সরকার অথবা ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বিরাগভাজন হয়েছে তাহলে সে তো গ্রেফতার হয়েছেই, তদুপরি পুলিশ তার হাড়-মাংস আলাদা করে দিয়েছে। ‘ক্রসফায়ারে’ অক্কা পেয়েছে এমন উদাহরণও আছে। এখন শুরু হয়েছে নতুন উপসর্গ—সরকারি দলের মধ্যে কোন্দল। ফলে যেসব সন্ত্রাসী সরকারের অলিখিত আশীর্বাদ নিয়ে চলে তাদের বুদ্ধি খরচ করে প্রথমেই এই ধাঁধার উত্তর বের করে নিতে হচ্ছে যে, কোনো উপদলের সঙ্গে থাকলে সে নিরাপদ থাকবে এবং তার অপরাধগুলো নিশ্চিন্তে করে যেতে পারবে।
এরই মধ্যে পুলিশকেও পাকা খেলুড়ে হতে হচ্ছে। তারা জেনে গেছেন যে আজকের ক্রিমিন্যাল হয়ে যেতে পারে আগামীকালের ‘হিরো’। তাই ওই অপরাধীর মামলার কাগজপত্র, সাক্ষী সাবুদের রেকর্ড এমনভাবেই তৈরি করেন যে, সে বিচারিক আদালতে শাস্তি পেলেও উচ্চ আদালতে গিয়ে আপিল করে খালাস পেয়ে যাবে। বিভিন্ন সময়ের চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের উচ্চতর আদালতের রায়ে মুক্তি পেয়ে যাওয়ার একটা তালিকা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। আর এসব অপরাধীর মধ্যে অন্তত কিছুসংখ্যককে হলেও কোলে টেনে নেয়ার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত, তা সহজেই বোঝা যায় যখন এগুলোর নেতারা নির্বিকারভাবে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা একজনকে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী বলি কী করে?’
শুরুতেই রুবির প্রাণনাশের যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি সে ধরনের অর্থাত্ প্রবাসে কর্মরতরা স্ত্রী বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যার কাছে টাকা পাঠায় তাদের মধ্যে খুন হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা এখন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে আমাদের সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের পুলিশ বিভাগে যদি অপরাধপ্রবণতার ধারা অথবা ক্রিমিনোলজি নিয়ে নিয়মিত মনিটরিং ও গবেষণার ব্যবস্থা থাকত, তবে এ বিষয়ে বেশ স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। পুলিশের তদন্তকর্মে তা সহায়ক হতো এবং সমাজে এ সমস্যাটি নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা হতো।
তবে বাংলাদেশে খুনোখুনির বিষয়টা সরকার গায়ে লাগাক না লাগাক সমাজের জন্য যে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সে কথা প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছাড়া আর কেউ অস্বীকার করবেন না। বিশেষ করে গত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর সিলেট ও চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জ ও জামালপুর জেলা শহরে যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেগুলো প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এসব অপরাধের ঘটনা সরকারও কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতে পারছে না। অবশ্য মানুষের মনের আড়াল করার চেষ্টা এ সরকারই যে প্রথম করছে তা নয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময়ে একবার সংবাদপত্রগুলোকে ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়েছিল যে হত্যাকাণ্ডের খবর যেন প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা না হয় আর নিহতের ছবি যেন একটু অচাঞ্চল্যকরভাবে ছাপা হয়। এতে কিন্তু অপরাধপ্রবণতা বা খুন-খারাবি কমেনি এবং এসব গা-ছমছম করানো খবর আপন ‘শক্তিতেই’ আবার প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান করে নিয়েছিল। সেসব খবর আবার ক্ষমতা দখলের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেরই মনে থাকতে পারে যে, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া চট্টগ্রামে কিছু সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হওয়ার পর তত্কালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন এবং তারপর রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাকে গদিচ্যুত করার জন্য জেনারেল এরশাদ যেসব কারণ দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি আর ইমদু নামে এক খুনের আসামিকে যে সেই সময়ের এক উপমন্ত্রীর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেই ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। তবে অপরাধের সংবাদ পত্র-পত্রিকায় এখন কী রকমভাবে প্রকাশ করা হবে আমি সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি প্রথমত বলতে চাচ্ছি, সম্প্রতি পরপর অনেক খুন হওয়ায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে অধুনা অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে এবং তার মাত্রা সর্বসাধারণ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার মতো। দ্বিতীয়ত, যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটলো সেগুলোর কারণ, পরিস্থিতি ও পরিবেশ সবকিছুই গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা কয়েকটি কারণেই অতীব প্রয়োজনীয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনকার খুনিদের উদ্দেশ্য, মানসিকতা, তাদের চক্র, অস্ত্র, পদ্ধতি, পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে নিয়মিতভাবে ধারণা পেতে হবে, যাতে তারা অপরাধীকে প্রতিরোধ ও গ্রেফতার করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন।অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এরকম পূর্ব-ধারণা ও প্রস্তুতি থেকে সরকারও জানবে যে পুলিশবাহিনীকে প্রস্তুত রাখার জন্য কী সহায়তা দিতে হবে। তৃতীয় জরুরি বিষয় হচ্ছে, অপরাধপ্রবণতা এবং তার কারণ সম্পর্কে পুলিশ ও সরকারের সব সময় পরিষ্কার ধারণা থাকলে তারা জনগণকে অর্থাত্ সমাজকে সময় থাকতে সতর্ক ও সচেতন করতে পারবে প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, অপরাধীকে অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত করতে সামাজিক পরিবেশ অনেক দূর সাহায্য করতে পারে।
সেই পরিবেশ তৈরি করতে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, শান্তি-অশান্তি, প্রশংসনীয়-নিন্দনীয় এবং পুরস্কার ও সাজা সম্পর্কে ঘরে ঘরে ধারণা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এ কাজের জন্য সমাজে, সরকারে ও রাজনৈতিক মহলে যে মূল্যবোধ ও জ্ঞানচর্চা থাকা প্রয়োজন, তা এ মুহূর্তে আমাদের দেশে দুঃখজনকভাবে অনুপস্থিত। যার বা যাদের কথায় সমাজে এই চেতনা তৈরি হতে পারে সে রকম মহত্ নেতা বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও আপাতত বাংলাদেশে নেই। তবুও আশা করব যে, বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনে সক্ষম এমন কোনো বা একাধিক মহান ব্যক্তিকে আল্লাহ অদূর ভবিষ্যতে আমাদের মাঝে পাঠাবেন। তাহলে অজ্ঞানতা, অস্পষ্টতা, মিথ্যাচার, পাপ আর অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সমঝোতা করার দিন ফুরাবে।

No comments

Powered by Blogger.