রাজপথে প্রতিবাদ-একটি ব্যতিক্রমী হরতাল

বামপন্থি দুটি জোটের ডাকে মঙ্গলবার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা একটি শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের দ্রুত বিচার, আশুলিয়ায় তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় মালিকসহ দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়।
হরতালের সমর্থনে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের আরও অনেক স্থানে মিছিল-পিকেটিং হয়েছে। কিন্তু কোথাও যানবাহনে হামলা ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ব্যানার-ফেস্টুন ছিল। রিকশা-সিএনজি যানবাহন কিছু চললেও জোরজবরদস্তি, ভাংচুর বা আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। হরতাল আহ্বানকারীরা আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা একটি ব্যতিক্রমী শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনে সচেষ্ট থাকবেন। তারা কথা রেখেছেন এবং এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রেখে হরতাল পালনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। হরতালের সময় রাজপথে গণসঙ্গীতের আয়োজনে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। সহিংসতা না থাকায় এমনটি ঘটতে পেরেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সংযমের পরিচয় দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার প্রশ্নে সরকার ও হরতাল আহ্বানকারী বামপন্থিদের অবস্থানে দর্শনগত মিল থাকার কারণে এমনটি হয়ে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আগের দিন আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ব্যাপক যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। টেলিভিশনে এ দৃশ্য দেখে গাড়ির মালিক-চালকরা সতর্ক হয়ে যান এবং হরতালের আগের বিকেল থেকেই আতঙ্কে রাজপথ অনেকটা যানবাহনশূন্য হয়ে পড়ে। গতকালের হরতালে এমন চিত্রও ছিল অনুপস্থিত। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সংযত আচরণই প্রত্যাশিত। এ দেশে বামপন্থিরা দীর্ঘদিন 'জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো' স্লোগানে অভ্যস্ত ছিল। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের কথা তারা বলেন প্রকাশ্যে এবং এ কারণে তাদের সম্পর্কে জনমনে এক ধরনের ভীতিও পরিলক্ষিত হয়। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাখলেও বিভিন্ন শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনসহ অন্তত ৩০টি সংগঠনের ডাকা হরতাল ছিল ব্যতিক্রমী। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল তার আবেদন হারিয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। হরতাল সাধারণ জীবনে অশেষ কষ্ট ডেকে আনে। শ্রমজীবীরা বঞ্চিত হয় জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকে। এসব বিবেচনায় ইস্যু-দাবি যা-ই হোক না কেন, আমরা হরতাল সমর্থন করি না। এ ধরনের কর্মসূচি প্রকৃতই কর্মনাশা। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকও সম্ভবত আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত হবেন।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে পরিস্থিতি অগি্নগর্ভ হতে পারে, এমন শঙ্কা জনমনে রয়েছে। সরকার ও বিরোধী পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। হরতাল-অবরোধ পালনের পর বিএনপি বলছে যে, তারা আরও কঠোর কর্মসূচি দেবে। জামায়াতে ইসলামী চরম সহিংস পথে চলেছে এবং সাধারণ মানুষ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার ভণ্ডুল করতে চায়, এমন ধারণা জনমনে প্রবল এবং সেটা অমূলক নয়। যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অশান্ত করে তোলার জন্য তারা তৎপর রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির নেতৃত্বও এ নিয়ে শঙ্কিত। এ অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্ব কি আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পারবে? সরকার পক্ষও কি প্রয়োজনীয় সংযম প্রদর্শন করবে? গতকালের হরতাল কিন্তু উভয় পক্ষের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.