বিদ্যুৎ নিয়ে জনগণকে অন্ধকারে রাখলে চলবে না-দুর্বিষহ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে শুরু করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুতের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষোভ-অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে—বিদ্যুৎ কার্যালয় ঘেরাও, ভাঙচুর, মিছিল-সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।


দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি আছে, আর তাই লোডশেডিং হবে—এত দিন গ্রাহকেরা যেন এ কথা মেনেই সরকারি নানা আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি আর পূর্বাভাসের বাস্তব প্রতিফলন দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু এখন রাজধানীসহ সারা দেশে দুর্বিষহ লোডশেডিংয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠায় তাঁরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
বিদ্যুৎ নিয়ে দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে আজকের এ অবস্থা। বিগত কয়েকটি শাসনামলে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রতিবছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, অথচ পুরোনো হয়ে যাওয়ায় এবং যথাযথ সংস্কারের অভাবে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কমছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের গতিও ধীর। বিগত কয়েকটি সরকার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বললেও এখনো পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই; বরং দীর্ঘসূত্রতা, দরপত্র নিয়ে অস্বচ্ছতাসহ দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান সরকারের দেড় বছরের শাসনকালে বিদ্যুত্সংকট সমাধানের বিষয়টি অনেক আলোচিত হয়েছে, সরকারের অনেক উদ্যোগের কথাও শোনা গেছে, কিন্তু জনগণ এর কোনো ফল পায়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, বর্তমান সরকার গত প্রায় দেড় বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে যে কাজ করেছে, জনগণ এখন তার ফল দেখতে চায়—তাঁর এই বক্তব্য আসলে জনগণের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটায়।
এর পরও যখন ১০-১৫ মিনিট বা আধাঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার যন্ত্রণা পোহাতে হয় অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলে, তখন মানুষের হতাশ না হয়ে উপায় কী। এই অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যেও বিতরণ ব্যবস্থাপনায় কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। সারা দেশে বিদ্যুৎ সমবণ্টনের সরকারি নীতি এভাবে লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
২০০৯ সালের বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ২০১১ সালের মধ্যে মোটামুটি একটি অবস্থায় পৌঁছানো যাবে। আমরা তখন বলেছিলাম, এ ধরনের ঢালাও আশ্বাস না দিয়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকারের ঘোষণা করা উচিত, আগামী ছয় মাসে আমরা কী পাব, ২০১০ সালে কতটা অগ্রগতি হবে এবং ২০১১ সালে কত মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে আমরা কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, এ বছর ৬ আগস্টের প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত আর উৎপাদন ঘাটতিই বা আসলে কত, তা কেউ জানে না। মধ্যরাতে কিংবা সারা রাত ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ের কারণ আসলে সেটাই।
বিদ্যুৎ নিয়ে জনগণ এখন অন্ধকারে। আমরা বারবার বলেছি, নির্দিষ্ট সময় পরপর বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত অবস্থা জনগণকে জানাতে হবে। তা করা না হলে বিদ্যুৎ নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ-অসন্তোষ রয়েছে, তা কমবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জনগণের বিক্ষোভ অনেক সময় শান্তিপূর্ণ থাকছে না। এই বাস্তবতায় জনগণের উদ্দেশে আমরা বলতে চাই যে, সহিংসতা, ভাঙচুর বিদ্যমান অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটায় না, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করে। সহিংসতার এ পথ অবশ্যই পরিহার করা উচিত। অন্যদিকে জনগণের এই ক্ষোভকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দ্রুত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় করে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ নিয়ে জনগণকে দেওয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে আপাতত পুলিশ দিয়ে দমানো গেলেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অসন্তোষের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হবে।

No comments

Powered by Blogger.