রাজধানী-অপরিকল্পিত নগরায়নণ ও জনদুর্ভোগ থেকে মুক্তির উপায় by মোজাফ্ফর আহমদ

ঢাকা একটি সমস্যা-সংকুল শহর। তবুও এ শহরের আকর্ষণ অনেক। এর প্রধান কারণ আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে এ শহর অবস্থান করছে ৬০ বছর ধরে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল কর্মকাণ্ড এ শহরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ফলে এ শহরে নানা পেশা ও নানা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে।


এ দেশের যেকোনো প্রান্তে জীবিকার সমস্যা দেখা দিলে আয়ের সন্ধানে নারী ও পুরুষ এ শহরেই ছুটে আসে। ফলে একদিকে যেমন নীতি-প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ ও সুবিধার বিস্তার ঘটেছে, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেরও পুঞ্জীভবন এ শহরেই ঘটেছে।
শিক্ষার জন্য, স্বাস্থ্য সেবার জন্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মানুষ এ শহরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারের আর্থিক সংস্থা, ব্যবসা, শিল্প, আবাসন ইত্যকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ এ শহরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। এ শহরের জনস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নাগরিক চাহিদার ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়েছে কিন্তু এই নাগরিক সেবা দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এ শহর অর্জন করেনি। নগরজীবনের নানা সমস্যা চাহিদার দ্রুত বিস্তৃতি ও সরবরাহের সীমিত প্রসারণ যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে তারই বহিঃপ্রকাশ পানির সংকট, গ্যাসের সংকট, বিদ্যুতের সংকট, যাতায়াতের সংকট, শিক্ষার সংকট ইত্যকার নানা পরিমণ্ডলে এটি পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
ঢাকাকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যে বিনিয়োগের প্রয়োজন সে বিনিয়োগ থেকে সরকারিভাবে বঞ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে এর ফলে যে বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে সেটাই বর্তমান সংকটের কেন্দ্রে অবস্থিত।
ঢাকার আদি যানবাহন ছিল নৌকা। যার মাধ্যম ছিল চার পাশের নদী এবং ৪২টি খাল। এই নদী এবং খাল সুরক্ষার যথাযথ সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব আদি ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করেছে। অথচ জলের বিকল্প স্থলযানের জন্য পরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি। ফলে জলাশয় বিনষ্ট হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে ঢাকার চারপাশে নানা মানের আবাসনের বিস্তার ঘটেছে এবং জীবনযাপন কর্ম বিনোদন ইত্যকার বিষয়ে নগর উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার অভাব নাগরিক সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। আমাদের এখানে বিভিন্ন অঞ্চলের আবাসন ও ব্যবসা বাণিজ্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পের যে মিশ্রণ ঘটেছে সেটি যথাযথ নয় বলেই মানুষের যাতায়াতের চাহিদা অপরিকল্পিতভাবে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তরা থেকে স্বাস্থ্য সেবার জন্য অনেককেই ঢাকার কেন্দ্রে আসতে হয়। শিক্ষার জন্য গেন্ডারিয়া থেকে রমনায় ছুটে আসে মানুষ। শিল্পশ্রমিক কয়েক ক্রোশ হেঁটে তারা কর্মস্থলে পৌঁছায়। পরিকল্পিত নগরায়ণ যানবাহনের চাহিদাকে একটি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসতে পারত। সেটি আরও জটিল হয়েছে নীতিপ্রাতিষ্ঠানিক আয় উপার্জনের প্রয়োজনে।
এ ছাড়া ঢাকায় ষাটের দশকে সরকারি সড়ক পরিবহনব্যবস্থা, অপরিকল্পিত বেসরকারি পরিবহনের বিস্তার তাকেও ক্রমান্বয়ে জটিল করে তুলেছে। ঢাকার অন্য শহরের মতো বেসরকারি যানবাহনের ব্যবহারে যথার্থ নিয়মতান্ত্রিকতা দেখা যায় না। বাস যেখানে- সেখানে থামে, যেখান-সেখান থেকে যাত্রী তোলে এবং যতজনের বসার বা দাঁড়ানোর জায়গা আছে তার চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে। এ ছাড়া কত সময় পরে বাস পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারে না। অটোরিকশাচালকদের ব্যবহার অনেকটা একচেটিয়া ব্যবসায়ীর মতো। নানা গতির যানবাহন একই রাস্তায় চলাচলের কারণে এবং চালকদের আইন অনুযায়ী যান চালনায় অনীহার জন্য বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে যানজটের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
রাস্তা নির্মাণেও একজাতীয় অপরিকল্পনার পরিচয় মেলে। ফলে একটি রাস্তায় এক কিলোমিটারে চার থেকে আটটি ট্রাফিক সিগন্যালের সম্মুখীন হতে হয়। উল্লেখ্য, এই সিগন্যালগুলো সময় সমন্বিত নয়। নগর সম্প্রসারণের প্রবণতায় উত্তর-দক্ষিণের রাস্তা প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু পূর্ব-পশ্চিমের যাতায়াত পরিকল্পিতভাবে সহজ ও সাবলীল করা হয়নি। নগর পরিকল্পনা যথাযথ না হলে গণপরিবহনের পরিকল্পিত বিস্তার না ঘটলে জনপথ ও রেলপথকে কার্যকর না করলে এবং শহরকে মিশ্র অবস্থান থেকে পরিকল্পিত ঐকিক অবস্থানে আনতে না পারলে যানজটের সমস্যা দূর করা প্রায় অসম্ভব। অল্পকথায় ঢাকা নগরের পরিকল্পিত পুনঃনগরায়ণ সম্ভব করে তোলাই যানজটের সমস্যার কিঞ্চিত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
ঢাকায় নদীগুলো ছিল এ নগরের প্রাণ। নদীর তীর ঘেঁষেই এ নগরের বিস্তৃতি ঘটেছিল। ফলে আদি ঢাকায় শহরের গভীরতা ছিল সীমিত। জনবিস্ফোরণের ফলে নানাভাবে জলাশয় ভরাট করে প্রকৃতির দেওয়া ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করা হয়েছে। এর সম্ভবত প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ধোলাইখাল। এ ছাড়া বড় বড় যে সাতটি খাল ছিল সেগুলোও আবাসনের আগ্রাসনে যখন বিলুপ্ত হচ্ছে তখন নগর কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা জেলা প্রশাসন এর বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে দখলদারদের সঙ্গে একপ্রকার সহায়তা করেছে। ফলে সিএস রেকর্ড, এসএ রেকর্ড ও আরএস রেকর্ডের নানা রকম বিকৃতি ঘটেছে। এই আগ্রাসী প্রভাবশালী দল নদী দখলেও যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছে।
নগরের প্লাবন ভূমি লুণ্ঠিত হয়েছে, নদী থেকে তোলা বালু ভরাট করে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা হয়েছে। এবং সেখানেও যথাযথ নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি সংকটময় আবর্তে ঘুরতে থাকে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন নতুন ও পুরান ঢাকায় শিল্পবর্জ্যের বিস্তৃতি ঘটায়। এই বর্জগুলোকে অবলম্বন করেই নদীদূষণ ও দখল প্রক্রিয়ার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানও এ তৎপরতায় যুক্ত হয়েছে।
নদী দখল ও দূষণের বিপক্ষে গত শতকের শেষে নাগরিক প্রতিবাদ জোরালো হলেও কার্যকরভাবে নদী ব্যবস্থাপনায় কোনো সমন্বিত উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। সাম্প্রতিককালে পরিবেশবাদীদের আবেদনে উচ্চ আদালত সময় বেধে দিয়ে চার জেলার প্রশাসন ও কয়েকটি সরকারি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন। কিন্তু সে নির্দেশনাও যথাযথভাবে পালিত হয়নি। বরং অবৈধ স্থাপনা একবার ভাঙা হয়েছে, আবার সেখানে নতুন স্থাপনা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ দিন এই ভাঙা-গড়ার মহড়াই চলছে।
এর সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে ঢাকার ভূমি ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশদ পরিকল্পনা বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সাতটি মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশনা, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ আমলে নিয়ে নাগরিকদের সুপেয় পানির অধিকারকে নিশ্চিত করতে নদীগুলোর ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো কিকল্প নেই।
বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ, এখানে পূর্বকালে এক হাজার ২০০ নদী ছিল। বর্তমানে বর্ষাকালে ২৫০টি নদীর নাব্যতা থাকে। শুষ্ক মৌসুমে সেটা প্রায় ১৫০-এ নেমে আসে। এই নদীগুলো পরস্পর অন্বিত। আবার চারপাশের নদীর সুব্যবস্থাপনার জন্য এসব নদীর সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, আমাদের নদীগুলোর উৎস ভিন্ন দেশে। সে দেশগুলো নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে আমাদের ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি না দিলে এবং নদীব্যবস্থাপনার প্রাযুক্তিক ও ভূ-তাত্ত্বিক দিকগুলো যথাযথভাবে গুরুত্ব না পেলে উন্নয়নে নদীগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানবিষয়ক অজ্ঞানতা আমাদের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সংকটের সৃষ্টি করেছে। এবং সেই সংকটকে পুঁজি করেই নদী দখল ও দূষণ প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। নদীর দখল ও দূষণ বন্ধ করতে পরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়টি আমাদের উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্রে স্থান দিতে হবে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ-সংকটের মোকাবিলায় সরকার নানা সময়ের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় রমজান মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এটি সাময়িক ব্যবস্থাপনা হতে পারে কিন্তু শিক্ষার গুরুত্ব মেনে নিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক একাডেমি ক্যালেন্ডার থেকে বিচ্যুত হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।
স্মরণীয় যে আমরা উচ্চশিক্ষায় এখনো অনিয়মতান্ত্রিকতার ফলে সেশন জট থেকে মুক্ত হতে পারিনি। পরীক্ষার সময় নির্দিষ্ট রেখে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সেশনজট পরিলক্ষিত না হলেও শিক্ষার মানের ওপর যে কোনো হস্তক্ষেপ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যবহার আকস্মিক স্কুল বন্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে শিক্ষার বিস্তৃতি ও মানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয়। এদিক থেকে বিদ্যুৎ ঘাটতির ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান সিদ্ধান্ত আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।
আমরা দ্রুত বিদ্যুৎ চাহিদা ব্যবস্থাপনার রূপকল্প নিয়ে আলোচনা দেখতে চাই। এবং সে ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্বকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে আমরা আশা রাখি। শিক্ষায় নিয়মতান্ত্রিকতা ভঙ্গ করলে মানবসম্পদ সৃজনে যে ঘাটতি সৃষ্টি হয় সেটি অপূরণীয়ই থেকে যায় এবং তার ফল চক্রবৃদ্ধি হারে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। ঢাকার বর্তমান যানজট ও জলজট তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমরা সমস্যার সমাধান চাই এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে ঢাকাবাসী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের উচিত হবে পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত নগরায়ণের সমস্যা উত্তরণ করে বিকেন্দ্রীভূত স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে নাগরিক চাহিদা মেটানোর স্বীকৃত পথকে বাস্তবায়িত করা।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ; টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.