নখের যোগ্যতা নখের অযোগ্যতা by রণজিৎ বিশ্বাস

শব্দকে আমরা ছোবড়া বানাতে ভালোবাসি। রচন হোক কি বচন, লিখন হোক ভাষণ_ সব জায়গায় আমরা এমন করি। শব্দগুলো সব একসঙ্গে মনে পড়ে না, নইলে উদাহরণের পিলার মজবুত হতো। আপাতত মনে পড়ছে 'আর্থসামাজিক অবস্থা'। একটি সময় এসেছিল, যখন এ শব্দটির ব্যবহার বড় বেশি হতো।


কাগজের পাতা ও বক্তৃতা এর ব্যবহারে সয়লাব হতো। আমরা বুঝেও ব্যবহার করতাম, না বুঝেও।
যার অ্যাকটিভ ভোকেবুলারিতে শব্দটি আছে, সেও করতাম; যার নেই, সে আরও বেশি করতাম। যে বুঝতাম না শব্দটি খাওয়ার কি গায়ে মাখার, সে সবচেয়ে উৎসাহিত থাকতাম। অবস্থা হয় পুরনো এক গল্পের মতো। 'কতিপয় পিতা'র গল্প।
এক তরুণ শহরে এসে অনেক নতুন নতুন শব্দ পেল। এর মধ্যে তার সবচেয়ে ভালো লেগে গেল 'কতিপয়'।
তার মনে ভাবনা এলো, বাবার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লেখার সময় আমি নতুন নতুন শব্দ ব্যবহার করব বাবাকে ইমপ্রেস করার জন্য।
এখন এলো করার পালা। করবি তো কর, একেবারেই শুরুতেই কর, তাই সে চিঠির শুরুতেই খুব যত্ন করে বসাল_ কতিপয় পিতা, সালাম গ্রহণ করিবেন।
বাকিটা বুঝে নিতে হবে। কী হয়েছিল বাবার অবস্থা, কল্পনায় আঁটিয়ে নিতে হবে।
আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপারটিকেও আমরা অনেকটা সে রকমই করে তুলেছিলাম।
তারপর পেয়েছিলাম একটি শব্দগুচ্ছ 'বিমান' নিয়ে স্পোর্টস রিপোর্টে। ক্রিকেটে বিমান কেমন খেলছে সেটি বোঝানোর জন্য কিছু শব্দ, কিছু চিত্র, কল্পচিত্র ও চিত্রকল্পকে আবার আমরা ছোবড়া বানাতে শুরু করলাম। যেমন_ বিমান আকাশে উড়ল, বিমান উড়তে পারল না, উড়তে বিমানের অসুবিধা হলো, বিমান আকাশে গোত্তা খেলো, বিমান ডানা ভেঙে পড়ল, বিমান দুর্ঘটনায় পড়ল, বিমানের টেইক-অফ ভালো হলো না। বিমানের ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং হলো ইত্যাদি।
এমন আরেকটি শব্দবন্ধ সম্প্রতি আমাদের ওপর সওয়ার হয়েছে। 'নখেরও যোগ্যি নয়'।
কখনও কখনও ভাবনায় পড়ে যাই। কেউ কারও যোগ্য নয়, কারও চেয়ে কেউ কম যোগ্য_ প্রথমত, এটি মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কতটুকু কৌশল-কুশলতা আমরা অবলম্বন করব, সেটি এক ভাবনা; দ্বিতীয় ভাবনা হচ্ছে, নখের উপমা একেবারে অপরিহার্য কি-না, রুচিগ্রাহ্য কি-না, আমাদের ভাষাটি এত দুর্বল ও মনের ঝাল মেটাতে কিংবা অন্তরের আগুন নেভাতে এতই অপারঙ্গম ও সীমাবদ্ধ কি-না। অথবা কেউ একজন ব্যবহার করে দৃষ্টি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করেছেন বলে আমাকেও তা করতে হবে না।
তিনি তার নখেরও যোগ্য নয়_ প্রথম শুনলাম কারও কারও কাছে বড় সম্মানিত এক ব্যবহারজীবীর মুখে। তার কয়েকদিন পর মওলানা ভাসানী সম্পর্কে বলার সময় তপ্ত ও ঝাঁজালো গলার এক আত্মবিশ্বাসী তরুণ অধ্যাপকের মুখে। অন্যের সমালোচনা নিজের ওপর টেনে নেওয়ার কৌশলে তিনি বললেন, আমরা তো তার নখেরও যোগ্য নই। ভালো লাগল। মন বলল, এটিই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু স্বাভাবিকতা যে আমার উপদ্রুত সংসারেও হামলা চালাবে তা ভাবতে পারিনি।
আমাকে যিনি সংসারের সবচেয়ে অযোগ্য প্রাণী মনে করেন, তিনি আমাকে বললেন_ তুমি আমাকে ওইটি করে দাও।
আমি বললাম, দুটি কথা। প্রথমত, সেটি এখন আমাদের প্রয়োজন নেই; দ্বিতীয়ত, সেটি করার সামর্থ্য আমার এখনও হয়নি। আমি পারব না।
: অমুখ যে পারল!
: তিনি অনেক বুদ্ধিমান, অনেক ক্ষমতাবান। অনেক চতুর।
: তিনি কি তোমার চেয়ে বড় চাকরি করেন?
: না।
: তাহলে যে তিনি পারলেন!
: তিনি পেরেছেন তার ক্ষমতায়, আমি পারব না আমার অক্ষমতায়।
: বুঝেছি।
: কী বুঝেছ?
: তুমি তার নখেরও যোগ্য নও।

রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক ও রম্য লেখক

No comments

Powered by Blogger.