জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-‘বন্ধুত্বের হয় না পদবি’ by আলতাফ শাহনেওয়াজ

‘বন্ধুত্বের হয় না পদবি, বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না...’ চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর বসে অঞ্জন দত্তের গানটি গাইতে গাইতে গিটারে টুংটাং করছেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুমিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার চায়ের দোকানের আটপৌরে আসরে তিনিই এখন গায়ক।


তাঁকে ঘিরে আছে বন্ধুরা, কেউ টেবিল চাপড়ে তাল মেলাচ্ছেন, চুমুক দিচ্ছেন চায়ের কাপে, কেউ বা আবার আয়েশি ঢঙে বসে আছেন শ্রোতার ভূমিকায়। পাশের খাবারের দোকানগুলোতে তখন দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। রয়েছে অনেক পদের রান্না—মাছ, মাংস, ডাল ভুনা থেকে শুরু করে আছে অনেক রকমের ভর্তা—শুধু মাছের ভর্তাই কয়েক প্রকারের। এর মধ্যে দুপুরের সূর্য মাঝ আকাশে চলে এসেছে। ধীরে ধীরে বটতলায় বাড়ছে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। দোকানিদের দম ফেলার ফুরসত নেই এ সময়। ঢাকার অদূরে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল বটতলার এক দুপুরের চিত্র এটি।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসগুলোর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বটগাছের পাদদেশে কয়েকটি খাবারের দোকান নিয়ে বটতলা গড়ে উঠেছে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। প্রথম দিকে দু-একটি দোকান থাকলেও বর্তমানে দোকানের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। এই দোকানের সারি এখন আ ফ ম কামালউদ্দিন হল থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু খাবার জন্য নয়, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে কিংবা এক কাপ চায়ের জন্যও বটতলায় আসেন অনেকে। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী কাইজার তো বলেই ফেললেন, ‘বটতলায় না এলে জাহাঙ্গীরনগরের উত্তাপ বুঝব কী করে?’ এই স্থানকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের আড্ডায় উঠে আসে কত না প্রসঙ্গ—লেখাপড়া, রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত, সমসাময়িক বিষয়, বিসিএস প্রস্তুতি—কোনো কিছুই বাদ নেই। আড্ডা চলে রাত অবধি। এ রকম এক আড্ডায় কথা হলো বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাইয়ান রাজির সঙ্গে। তাঁর হাতে তখন আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বই। বললেন, ‘বন্ধুর জন্য নিয়ে এসেছি, ওর এখানে আসার কথা।’ এ সময় পাশে বসে থাকা দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী শাহেদ জানালেন, ‘বটতলায় না এলে আমাদের দিন যেন পরিপূর্ণ হয় না। হলে ডাইনিং-ক্যানটিন দুটোই আছে। তার পরও এখানে আসি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার লোভে।’ শাহেদের কথার সূত্র ধরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নূপুরও বললেন, ‘মাঝেমধ্যে এমন হয়, আমরা হল থেকে খাবার রান্না করে এনেও বটতলায় খাই।’
স্বল্পব্যয়ে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার জন্য বটতলায় শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীরাই নয়, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের অনেকে আসেন সহকর্মী ও পরিবার নিয়ে। আট বছর ধরে বটতলায় খাবার দোকান চালাচ্ছেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি বললেন, ‘প্রতিদিন দুপুর ও রাতে তিন-চার হাজার ছাত্রছাত্রী এখানে খেতে আসেন। ছাত্রছাত্রী ছাড়াও শিক্ষকেরা আসেন।’
জাহাঙ্গীরনগরের বটতলা যেন আড্ডা ও বন্ধুত্বের প্রতীক। সুমিতরা যেমন এখানে গিটারের ঝংকার তোলে, তেমনই কবিতার বই হাতেও বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে কেউ। এ ছাড়া ছুটির সময় ডাইনিং-ক্যানটিন বন্ধ হলেও বটতলা সরগরম সব সময়। জাহাঙ্গীরনগরে ছুটির দিনগুলোতে তাই খাবারদাবারের ক্ষেত্রে বটতলাই একমাত্র সহায়।

No comments

Powered by Blogger.