চারদিক-নটর ডেমিয়ান ৮১ ব্যাচ: শোনো by মানস কুমার গোস্বামী

নটর ডেম কলেজের ৮১ ব্যাচের বন্ধুরা বিশেষ করে, গ্রুপ ৩-এর বন্ধুরা, তোমাদের সবাইকে বলছি, সালেককে মনে পড়ে? কলেজের তিনতলার পূর্বের কোণে যে বিরাট হলটিতে গ্রুপ ৩-এর ক্লাস হতো, দরজা বরাবর মাঝের দিকে যে ছেলেটা বসত! মোটাসোটা, গাবদা-গোবদা, ঘাড় খাটো, গোয়ার, কিন্তু দুষ্টের শিরোমণি ছেলেটা।


অঙ্ক ক্লাসে এস করিম স্যার ‘সাইলেন্স প্লিজ’ বলে যে-ই বোর্ডের দিকে তাকাতেন, অমনি দরজাগলে যে ছেলেটা প্রথম দৌড়ে পালাত—যার পথ ধরে একে একে আমরাও অনেকেই দৌড় লাগাতাম। এক দিন কোত্থেকে একটা এক ডাঁটির এক চোখ ভাঙা চশমার ফ্রেম এনে নাকের ওপর সেঁটে পণ্ডিত সেজে স্যারদের প্রশ্ন করেছিল। তারপর সেই চশমার একে একে অনেকের হাতঘুরে বেড়ানো আর সেই কর্মটির পুনরাবৃত্তি। একপর্যায়ে আমাদের কৌতুক যখন স্যার ধরে ফেললেন, তখন কী বকুনির ধোলাই!
আমার কলেজজীবনের যত মজার স্মৃতি, এর প্রায় সবটাই ওকে ঘিরে। ফিজিকস ল্যাব থেকে দুষ্টুমির কারণে ডেমনেস্ট্রেটর সেদিন কীভাবে ওকে আর আমাকে বের করে দিয়েছিলেন, আর আমরাও মুক্তির আনন্দে ক্যানটিনে টেবিল টেনিস খেলায় মেতে উঠেছিলাম। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। যে ছেলেটি সবাইকে শুধু আনন্দ দিত, ওর কথা বলার ধরন, চালচলনে সবাই আনন্দ পেত, সে আজ দুরারোগ্য ফুসফুস ক্যানসারের কামড়ে মুষড়ে পড়ে আছে সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইসিউইতে। ফুসফুসের যে সামান্য অংশটুকু অক্ষত আছে, তা দিয়ে শরীরের অক্সিজেন গ্রহণ পর্যাপ্ত হচ্ছে না। তাই গলা ফুটো করে শ্বাসনালিতে বসানো হয়েছে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র। শরীরময় ফুটো করে লাগানো বিভিন্ন যন্ত্রপাতির তার, প্রোব, টিউব ইত্যাদি। আর মাথার ওপর শ্বাসযন্ত্রের মনিটর, ইসিজির মনিটর ইত্যাদির একটানা গোঙানির শব্দ পুরো পরিবেশটাকে ভারী করে তুলেছে। ওরা ক্রমাগত জানান দিয়ে যাচ্ছে, বন্ধু সালেক পরাজিত। এই দুর্বল ফুসফুস, তার ওপর কেমোথেরাপিতে আরও শক্তিহীন দেহটা নিয়ে এত সব যন্ত্রপাতির ভেতরে নিস্তেজ পড়ে থাকে সারা দিন। দিনের পর দিন। কথা বলতে পারে না, কাগজে লিখে লিখে কাজ চালায়।
নটর ডেম কলেজ পার হয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা নেই। দেখা হলো নব্বইয়ের শুরুতে বারডেম হাসপাতালে চাকরির সুবাদে। ও এত দিনে সিলেট মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাস দিয়ে বারডেমে চাকরি করছে। প্রিয় বন্ধুটাকে এত দিন পর কাছে পেয়ে আমাদের দিনগুলো ভালোই কাটছিল। কয়েক বছর আগে হঠাৎই চলে গেল সৌদি আরবে চাকরি নিয়ে। ফিরে এল দু-তিন মাস আগে, সঙ্গে নিয়ে এল ফুসফুস ক্যানসার। সৌদি আরবে চাকরিটা ইস্তফাও দিয়ে আসেনি। খবর পেয়ে ছুটে যাই ল্যাবএইড হাসপাতালে। সেই সালেক প্রায় কথা বলতে পারে না। একটু কথা বললেই হাঁপিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন মাস্ক চেপে ধরে শ্বাস নিতে হয়। সেই থেকে ল্যাবএইড, স্কয়ার, ঢাকা মেডিকেল ও সেন্ট্রাল আইসিইউ করে আজ বাক্শক্তিহীন, চলৎশক্তিহীন, পর্যুদস্ত পুরোপুরি শ্বাসযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।
আমাদের বন্ধুটা হারিয়ে যেতে বসেছে; সঙ্গে সঙ্গে পরিবারটিও। দুই সন্তানের ছোটটি ফুটফুটে ছয় বছরের মেয়ে। ওকি জানে, কী ঘাতক জেঁকে বসেছে ওর বাবার শরীরে, ওদের পরিবারের? তিন মাসের আইসিউই চার্জ আর কেমোথেরাপি বাবদ ওর জমানো টাকাগুলো শেষ। সেদিন বন্ধু দিবসে ওকে দেখে এসেছি। অসাড় দেহটা এলিয়ে অসংখ্য যন্ত্রপাতির ভেতর আইসিইউ বেডে শুয়ে আছে আধো ঘুমে। আমাকে দেখে ওর চোখ দুটি চকচক করে উঠল, কিছু বলতে চাইছিল। ইশারায় বুঝে নিলাম—এই দুদিন আসিনি বলে খিস্তি দিল। আমি ওর বাঁ হাতটা স্যালাইন চ্যানেলসমেত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ও অসহায়ের মতো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওকে এ অবস্থায় মানায় না। দেখতে চাই না ওকে ওর অসাড় দেহের ভেতর, আবার যদি ওকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। নিজেকে এত অসহায় লাগছে! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আমাদের সবাইকে ওর পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমার গ্রুপ ৩-এর বন্ধুরা, এ দুর্দিনে তোমাদের কথাই সবার আগে মনে পড়ছে। নান্নু, আবেদ, জামি, শাহজাহান, রবিন, টুটুল, ধ্রুব, জাভেদ, সিরাজ, অনূপ, অসীম—আরও যাদের নাম বলতে পারলাম না, তোমরা যদি এ প্রতিবেদন পড়ে থাকো—যাকে যাকে পারো জানাও আমাদের এই উচ্ছল বন্ধুটির পাশে দাঁড়াও। ওর জন্য এখন টাকার বড় প্রয়োজন। বন্ধু, সহপাঠী যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, ওর অ্যাকাউন্টে কিছু কিছু করে টাকা পাঠাও। এটা সাহায্য নয়, সহযোগিতা। আমরা আর কারও কাছে হাত পাতব না। শুধু বন্ধুরা, তোমরা পাশে এসে দাঁড়াও। এ প্রতিবেদন পড়ে যদি অন্য কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে চান, আমরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করব। ওর কাছে টাকা পাঠানোর ঠিকানা: ICB ISLAMIC BANK LTD AC No : 002002500063102।

No comments

Powered by Blogger.