কালের পুরাণ-বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পাকিস্তানি যোগসূত্র by সোহরাব হাসান

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ভ্রাতৃপ্রতীম মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেন।


একই সঙ্গে তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সব সদস্য এবং তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি অনুরূপ আহ্বান জানান। তিনি ‘বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল ও ১৫ মিলিয়ন গজকাপড় পাঠানোরও নির্দেশ দেন। (হু কিলড মুজিব, এ এল খতিব)।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি চক্র প্রথমে বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিল। সেই ঘোষণা সম্ভবত ভুট্টোকে নতুন সরকারের সঙ্গে সখ্যগড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে।
ভুট্টোর এই পদক্ষেপ কি নিছক কূটনৈতিক কার্যক্রমের অংশ, না একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ? বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পাকিস্তান সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যে শুধু নীরব দর্শক ছিলেন না, ১৫ আগস্টের পূর্বাপর কিছু ঘটনা তাই প্রমাণ করে।
১৯৭৩ সালে ভুট্টো প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি বহাল রাখা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’
পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সেনারাও চলে যান। এর পরেও ‘বিদেশি আগ্রাসন’-এর কথা বলার অর্থ স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগমুহূর্তে ভুট্টো পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রকম যোগসূত্র রাখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বাঙালি নেতা বলেছিলেন, ‘তোমরা সুখে থাক। পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ (১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)।
শেখ মুজিবের এই চূড়ান্ত জবাব সহজভাবে নেননি ভুট্টো। ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগে তিনি ‘পাকিস্তানের দুই অংশ’কে এক করার তৎপরতা চালাতে থাকেন। বিশেষ উপদেষ্টা মাহমুদ আলীকে লন্ডনে পাঠান বাংলাদেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করার উদ্দেশ্যে। বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’-সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারক করা।
মাহমুদ আলী ভেবেছিলেন, লন্ডন থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমর্থন আদায় করবেন। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
বাংলাদেশে আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাসীন, ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে বেগম আখতার সোলায়মান (বেবী) ভুট্টোকে এক চিঠিতে লেখেন:
‘আমি সব সময় আপনাকে একজন অসীম সাহসী, অসাধারণ প্রজ্ঞা ও ব্যতিক্রমী দূরদর্শী মানুষ হিসেবেই জানি। “বাংলাদেশ” বিষয়ে আপনি সকল প্রত্যাশাকে অতিক্রম করে গেছেন। আপনি মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন দেখিয়ে অত্যন্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।’
উল্লেখ্য, বেগম আখতার সোলায়মান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
সৌদি বাদশাহ খালেদ খন্দকার মোশতাকের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘আমার প্রিয় ভাই, নতুন ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় আপনাকে আমি নিজের ও সৌদি জাতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’ (হু কিলড মুজিব, এ এল খতিব)
দুই মাস আগে, ১৯৭৫-এর জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে বলেন, ‘এ অঞ্চলে শিগগিরই কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।’ (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, স্ট্যানলি উলপার্ট)
এ এল খতিবের প্রশ্ন, দুই মাস আগে তিনি কীভাবে পরিবর্তনের পূর্বাভাস দিলেন?
মুসলিম লীগের নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর কারাগারে ছিলেন, তিনি ভুট্টোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে শুরু হোক’।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী সাংবাদিক জেড এ সুলেরি বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারত না যদি মুজিব বেঁচে থাকতেন।
চরম ডান ও বামের যোগাযোগ: এ এল খতিব তাঁর হু কিলড মুজিব বইয়ে আরও লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই এখানে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জুনে ভুট্টোর ঢাকা সফরের পর তারা মুজিববিরোধিতায় নামে। তাঁর সফরসঙ্গী সাংবাদিক ওয়াজিদ শামসুল হাসান ঢাকা থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে দাবি করেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি দপ্তরে ডি পি ধরের (ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম পরামর্শক) লোক আছে।’ যা ছিল সর্বৈব মিথ্যা।
শুধু ১৯৭৫ নয়, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই ভুট্টো বাংলাদেশবিরোধিতার প্রচারণা চালাতে থাকেন। তিনি বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। এ ব্যাপারে তিনি পাকিস্তানে অবস্থানরত কথিত বাঙালি নেতাদের ও রাজা ত্রিদিব রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অপপ্রচার চালিয়েছেন, বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মকর্ম পালন করতে দেওয়া হয় না। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী কামাল হোসেন এই নিবন্ধকারককে বলেছেন, ‘আমরা যেখানে যেতাম, এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম।’ ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সেঅনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিব সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে দেখা করে স্বীকৃতির অনুরোধ জানালে তিনিও ইসলামী প্রজাতন্ত্র করার প্রস্তাব দেন। শেখ মুজিব রাজি হননি।
বাংলাদেশের ভেতরে যাঁরা শেখ মুজিবকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, ভুট্টো তাঁদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা আবদুল হক একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালান। কিন্তু সেই লড়াইয়ের অর্থ ও অস্ত্র আসবে কোত্থেকে? তাঁরা ধরনা দিলেন পাকিস্তানের কাছে। ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বোধন করে এক চিঠি লেখেন তিনি। চিঠির ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
পুতুল মুজিব চক্র এখন জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও ওয়ারলেস সরঞ্জাম প্রদানের আবেদন জানাচ্ছি।’
১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবদুল হক লিখিত চিঠিটি ভুট্টোর কাছে পৌঁছায় ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি। চিঠিটি পাওয়ার পর তিনি ‘অত্যন্ত জরুরি’ বলে মন্তব্য করেন এবং এই ‘সৎ লোকটি’কে (আবদুল হক) ‘কার্যকর সাহায্য’ দেওয়ার সুপারিশ করেন।
আবদুল হক চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন সিলেটের মাহমুদ আলীর মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাহমুদ আলী দখলদার পাকিস্তানিদের পক্ষ নেন এবং এর ইনাম হিসেবে ভুট্টো তাঁকে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত (তাঁদের ভাষায় পূর্ব পাকিস্তান) বিশেষ উপদেষ্টার পদে বসান।
ভুট্টোর আরেকজন এজেন্টের নাম আবদুল মালেক। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে তিনিও সৌদি আরব যান। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের ২২ জানুয়ারি ভুট্টোকে চিঠি লেখেন ‘আমার প্রিয় নেতা’ সম্বোধন করে।
মালেক লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ৬৫ মিলিয়ন মুসলমান তাদের মুক্তির জন্য আপনার দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব লাভের জন্য গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করছে।’ (জুলফি ভুট্টো অব পাকিস্তান, স্ট্যানলিউলপার্ট)।
এই চিঠির জবাবে ভুট্টো ধর্মমন্ত্রী মাওলানা কায়সার নিয়াজীকে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে পাঠান। উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনৈতিক, আর্থিক সাহায্য তথা অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা। ভুট্টো ভেবেছিলেন, এঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ইসলামি রিপাবলিক নামকরণের জন্য মুজিব সরকার কিংবা তাঁর উত্তরসূরির প্রতি (তখনই তাঁরা উত্তরসূরি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল!) চাপ সৃষ্টি করা। একইভাবে ভুট্টো চেয়েছেন, পাকিস্তানি স্টাইলে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করাতে রাজি করাতে।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অর্থনীতিবিদ মুশাররফ হোসেন পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে করাচি গিয়েছিলেন থার্ড ওয়ার্ল্ড ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে। তাঁর মামা ছিলেন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর। তাঁর বাসায় যে কয়জন বিশিষ্ট পাকিস্তানি নাগরিকের সঙ্গে আলাপ হয়, তাঁদের একজন জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানের প্রদেশ হবে কি না। জবাবে মুশাররফ হোসেন বলেছিলেন, বাংলাদেশ তো এখন একটি স্বাধীন দেশ। তখন সেই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ওকে তো মেরে ফেলবে কয়েক দিনের মধ্যে।’ (আগস্ট স্মৃতি, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮)
আমেরিকান গবেষক ও লেখক স্ট্যানলি ওলপার্টের লেখা ভুট্টোর জীবনীতেও তাঁর (ভুট্টোর) মুজিববিরোধী তৎপরতার বর্ণনা আছে। ওলপার্টের বইয়ে আছে ‘দুই বছর যাবৎ ভুট্টো কয়েকটি মুজিববিরোধী দলকে তাঁর গোপন স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে অর্থসাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং এর বিনিময়ে ফল লাভ করেছিলেন।’ ২০০০ সালে স্ট্যানলি ওলপার্টের ঢাকা সফরের সময় লন্ডন-প্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বিনিময়ে ফল লাভ বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন? মুজিব হত্যায় কি পাকিস্তান জড়িত ছিল?’ ওলপার্টের উত্তর, ‘হ্যাঁ, আপনি তা বলতে পারেন।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল, র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, ২০০৮)
যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় নানা অপকৌশল: ১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পরিষদের অনুমোদন নিলেও তা ঠেকিয়ে রাখেন পরের বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বন্দী বিনিময় নিয়ে তিনি দরকষাকষি করতে থাকেন বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে। তিয়াত্তরের আগস্টের শেষ দিকে ভুট্টো প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদকে দিল্লি পাঠান। ২৮ আগস্ট জনাব আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ প্রতিনিধি পি এন হাকসারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতেই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হয়। চুক্তিতে পাকিস্তানে আটক বাঙালি এবং বাংলাদেশে আটক অবাঙালিদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ১৯৫ জন পাকিস্তানি বন্দীর বিচারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ভারত বলেছে, আপাতত এই যুদ্ধাপরাধীরা তাঁদের হেফাজতে থাকুক। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ঢাকা ও ইসলামাবাদ এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৮তম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি বন্দীকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন না। শেখ মুজিবকে দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন বা কমনওয়েলথ গঠন করাতে পারবেন, সেই আশা ভুট্টো ছেড়ে দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি একাত্তরের অন্ধকার দিনের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য দুই দেশের ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ককে পুনরুদ্ধারের বাসনা ব্যক্ত করেন। (২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভুট্টোর ভাষণ)
এরপর ভুট্টো একটি ফরাসি বার্তা সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে দেন, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ‘দ্রুত’ ছেড়ে না দেওয়া হলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সমস্ত প্রক্রিয়া নস্যাৎ হয়ে যাবে। চুয়াত্তরের ৮ এপ্রিল দিল্লিতে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অবশিষ্ট ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া: ইন্দিরার সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে যখন শেখ মুজিব দিল্লি যান, তখন ভুট্টো বেইজিংয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দৃশ্যত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ফারাক্কাসহ বহু অমীমাংসিত বিষয়ে মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক মতৈক্য ছাড়াই শেষ হয়। ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রবল আপত্তি ছিল।
ভুট্টো জুনে তাঁর প্রস্তাবিত বাংলাদেশ সফর স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফারাক্কা প্রশ্নে বাংলাদেশ-ভারত বিরোধের খবর জানতে পেরে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।
ভুট্টোর বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে শেখ মুজিব অনবহিত ছিলেন, বলা যাবে না। তাঁর ইসলামি সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ বৈঠকে যোগদান কিংবা বাংলাদেশে ভুট্টোকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায় এবং আটকে পড়া বিহারিদের ফেরত পাঠানো। দুটি বিষয়েই ভুট্টো শীতল মনোভাব দেখান। সম্পদের দায়দেনা বুঝিয়ে দিতে বলার প্রত্যুত্তরে তিনি শিষ্টাচারবর্জিত ভাষায় বলেছিলেন, ‘আমি ব্ল্যাংক চেক নিয়ে আসিনি।’
বাংলাদেশ সফরের আগে ভুট্টো একটি অগ্রবর্তী দল পাঠিয়েছিলেন, যারা সাবেক মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল উপহার হিসেবে বাসমতি চালও নিয়ে এসেছিল। দেশে ফিরে গিয়েও ভুট্টো বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। (হু কিলড মুজিব, এ এলখতিব)।
বাংলাদেশের নেতা এসব অপতৎপরতা সম্পর্কে জানতেন। এর প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করা যায় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ ও সাক্ষাৎকারে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘ভুট্টো সাহেব বক্তৃতা করেন, বাংলাদেশের অবস্থা কী? ভুট্টো সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, ফ্রন্টিয়ারের অবস্থা কী? অ্যারোপ্লেন দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করছেন। সিন্ধুর অবস্থা কী? ঘর সামলান বন্ধু, ঘর সামলান। এরপর তিনি সাফ জানিয়ে দেন, আমার সম্পদ ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধুত্ব হতে পারে না।’
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হয়নি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.