সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-কৃষি অনুষদে বিদায়ের সুর by সুমনকুমার দাশ

২০০৮ সালের ১৯ এপ্রিল। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কৃষি অনুষদ’ নামে নতুন একটি অনুষদের শুভ সূচনা ঘটল। সেই অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ। কয়েক দিনের মধ্যেই এসব শিক্ষার্থীর স্নাতক (সম্মান) কোর্সের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষি অনুষদে বাজছে বিদায়ের সুর।


‘এ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পড়া শেষ করে চলে যাওয়া মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের চিরচেনা প্রায় সব কটি মুখের প্রস্থান’—এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের গোটা পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী।
একটা অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এ চলে যাওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়জুড়েই বিদায়ের সুর বাজছে। কিন্তু কেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালাতেই এক অন্য ধরনের গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। গল্পটা ঠিক এ রকম: কৃষি অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে খুব একটা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা হতো না বললেই চলে। কিন্তু এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে বদলে দিল পুরো পরিবেশ। গান-নৃত্য-আবৃত্তি-অভিনয়-সাংবাদিকতা-কার্টুন আঁকা থেকে শুরু করে কোথায় নেই তারা! প্রচণ্ড শীতে দরিদ্র ও গরিব শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণ থেকে শুরু করে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে এসব শিক্ষার্থীর দৃপ্ত পদচারণা চোখে পড়ার মতো।
শিক্ষার্থী অশোক বিশ্বাসের মুখে নিজের সহপাঠীদের নিয়ে গর্ব ঝরে, ‘আমাদের ব্যাচ অনন্য ও অসাধারণ। এ ব্যাচের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই সৃজনশীল। আমাদের চোখে-মুখে ছিল আধুনিক মানের ক্যাম্পাসের চিত্র, সেটা করেছিও। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে মাতিয়ে রেখেছি ভবিষ্যতে নিজেদের মেধা দিয়ে গোটা দেশকে মাতিয়ে রাখব। বদলে দিব পুরো বাংলাদেশের চেহারা।’
লীনা জান্নাতুল ফেরদৌসের ইচ্ছেটা একটু অন্য রকম। তার ভাষায়, ‘সবুজ টিলা ঘেরা কতই না সুন্দর আমাদের ক্যাম্পাস। এই ছোট্ট ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাব ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে এখানকার ক্যাম্পাস আর বন্ধুদের নিয়ে উপন্যাস লেখার।’ রায়হানুল হায়দার বলেন, ‘হলের জীবনটা খুব মিস করব। মন খারাপ হলে সব বন্ধু মিলে আড্ডা মারার দৃশ্যটা কিছুদিন পর আর হবে না।’
সালাউদ্দিনের শারীরিক গঠন ও আদলের কারণে সহপাঠীরা তাকে ‘লম্বুম্যান’ অভিধায় সব সময় খেপায়। সেই ‘লম্বুম্যান’ বললেন, ‘পালাক্রমে বন্ধুদের জন্মদিন পালন করা আমাদের মধ্যে একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল। দেখা যায়—প্রতি মাসে কারও না কারও জন্মদিন থাকেই। কেক কেটে সবাই দল বেঁধে চা খেতে যেতাম। সে দিন আর ফিরে পাব না!’ ততক্ষণে রানা রায় অন্য প্রসঙ্গে কথা তুললেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে কত কত সমস্যা। অভাগা এই দেশটার জন্য কিছু করতে চাই।’ এ কথার সমর্থন জানিয়ে মাথা দোলালেন শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার।
রাকিবুল হাসান বলেন, ‘চার বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যেমন আনন্দ ছিল, তেমন কষ্টও ছিল। ব্যবহারিক ক্লাসের অসুবিধা থাকায় পড়াশোনায় বেশ প্রভাব পড়েছে। তবে মাঠে রোদে পুড়ে কাজ করার আনন্দটুকু নেহাত কম নয়! মাঠ পরিচর্যা থেকে শুরু করে বীজ লাগানো, আগাছা পরিষ্কার, পানি ও সার দেওয়া থেকে কৃষকদের মতো যাবতীয় কাজ করেছি।’ রাকিবুলের কথার মাঝখানেই ফোড়ন কাটেন ফাহমিনাজ তানহা নামের এক ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা মেয়েরাও তো কম করিনি, কোমরে ওড়না বেঁধে ছেলেদের মতো সমান কাজ করেছি। সেটা বলছ না কেন?’
পিঠা উৎসব, নবান্ন উৎসব, জাতীয় দিবস উদ্যাপন থেকে শুরু করে সব জায়গায় কৃষি অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দৃপ্ত পদচারণে মুখরিত থাকে ক্যাম্পাস। এ তথ্য জানিয়ে সুস্মিতা রানী সাহা বলেন, ‘আমাদের ছুটির দিন বলতে কোনো কথা ছিল না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আয়োজন লেগে থাকত।’
কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীদের কথা যেন শেষই হয় না। কথায় কথায় তাঁরা জানান, প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই ‘মৃত্তিকা’ নামে একটি সাহিত্য-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। এ সংগঠনের উদ্যোগে তিন মাস পরপর একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হয় এবং বাংলাদেশ বেতারে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। এ ছাড়া সিলেট শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও এই সংগঠনের সদস্যরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাংকির তলা, বৈশাখী চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত আড্ডার আয়োজন করা হতো বলে জানালেন আসাদুল্লাহ হোসাইন সাদ, পাপিয়া দাস, হুমায়ুন কবীর আকাশসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
সাংবাদিক সমিতি, রোভার স্কাউট, লিও ক্লাব, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত খলিলুর রহমান ফয়সাল। তিনি ক্যাম্পাসের বহুল পরিচিত ও প্রিয় মুখ। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করেছি। ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পরিবর্তন করতে পেরেছি।’
কৃষি অনুষদের প্রথম ব্যাচকে নিয়ে শিক্ষকদেরও গর্বের শেষ নেই। প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফসানা হোসাইন বলেন, ‘প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ দেখার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি। আসলে তারুণ্যে ভরপুর এ ছেলেমেয়েরা সব শিক্ষার্থীর অনুকরণ করার মতো।’ কৃষি অনুষদের ডিন ড. মোহাম্মদ নূর হোসেন বলেন, ‘প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে ক্যাম্পাসে একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, আশা করছি তরুণ-তরুণীদের দৃপ্ত পদচারণে সেই হাওয়া পুরো দেশেই লাগবে।’
sumankumardash@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.