খোলা চোখে-আমেরিকায় এসব হচ্ছেটা কী? by হাসান ফেরদৌস

‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দটা নতুন, যদিও ইসলামকে শত্রু বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা নতুন নয়। মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী, ৯/১১-এর ঘটনার পর আমেরিকার কোনো কোনো মহল থেকে এমন একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তার ফল হয়েছিল এই, কোনো কোনো শহরে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।


মসজিদেও হামলা হয়। পাগড়ি মাথায় এক শিখকে মুসলমান ভেবে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। তার বড় কারণ ছিল, আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে শহরের মেয়র ও পাড়ার পাদ্রি, সবাই সে সময় এক বাক্যে বলেছিলেন, সন্ত্রাসী হামলা যারা করেছে, তারা কেবল আমেরিকার শত্রু নয়, তারা মুসলমানদেরও শত্রু।
সেটা ছিল ২০০১ সালের কথা। এখন প্রায় এক দশক পর আমেরিকায় ইসলাম-বিরোধিতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অতি দক্ষিণপন্থী রেডিও-টিভির টক শোগুলোতে দিনরাত্রি ইসলামকে ভয়াবহ এক ধর্ম হিসেবে পরিচয় করিয়ে তাকে প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কোনো কোনো শহরে মসজিদকে লক্ষ করে জমায়েত ও মিছিল আয়োজন করা হচ্ছে। রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা ইসলামকে ঠেকানোর আহ্বান জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সারাহ পেলিন ও নুট গিনগ্রিচের মতো নামজাদা রিপাবলিকান নেতাও রয়েছেন। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, ফ্লোরিডার এক গির্জা থেকে এ বছর ১১ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সেই সন্ত্রাসী হামলার নবম বার্ষিকী উপলক্ষে ঘটা করে কোরআন শরিফ পোড়ানোর বহ্নুত্সব করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তালিবানি আফগানিস্তানে বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বাইবেল পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেনি। ধর্মের নামে সন্ত্রাস ঠেকাতে আমেরিকা গেল নয় বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে চলেছে। এখন তার নিজের ঘরেই যে ধর্মযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, তাকে ঠেকাবে কে?
আমেরিকায় যা হচ্ছে তাকে ধর্মযুদ্ধ বলে আমি হয়তো একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললাম। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। মুসলমানদের সঙ্গে লাঠালাঠির মতো তেমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি। তার বড় কারণ অতিক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর বাইরে ইসলামবিরোধী স্লোগান কেউ কানে তোলেনি। মূলধারার তথ্যমাধ্যমগুলো মোটের ওপর ইসলাম-বিরোধিতা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে প্রতিবাদের আওয়াজও উঠেছে জোরেশোরে। গত সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ার তেমেকুলাতে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য শুক্রবার মধ্যাহ্ন প্রার্থনার সময় যার যার কুকুর নিয়ে জমায়েতের এক পরিকল্পনা করেছিল স্থানীয় একটি রাজনৈতিক গ্রুপ। কুকুর নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল, কারণ মুসলমানেরা নাকি কুকুরকে নোংরা প্রাণী বলে জানে। এ নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, ফেসবুকে প্রচার চালানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বসাকল্যে জনাকুড়ি লোক সেখানে জড়ো হয়। আর কুকুর নিয়ে এসেছিল মোটে একজন। তাদের ঠেকাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজির হয়েছিল এমন মানুষের সংখ্যা ১০০রও বেশি। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস সে ঘটনার প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পাল্টা প্রতিবাদকারীদের উপস্থিতিতে মসজিদবিরোধী বিক্ষোভ ভণ্ডুল হয়ে যায়।
নিউইয়র্কেও মুসলমানবিরোধী প্রচারণা চলছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে ১৩ তলা এক মসজিদ ও ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার বানানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নানা মহলে উত্তপ্ত প্রচারণা চলছে। কর্ডোভা সেন্টার নামের এই ভবনের উদ্যোক্তা আমেরিকান সোসাইটি ফর মুসলিম অ্যাডভানসমেন্ট। তারা জানিয়েছে, এখানে কেবল মসজিদই থাকবে না। সর্বধর্মের মানুষের মতবিনিময়ের একটি মিলনকেন্দ্র হিসেবে একে গড়ে তোলা হবে। যাঁরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের বক্তব্য, ৯/১১-এর হামলাকারীরা সবাই ছিল মুসলমান। এখন সেই ট্রেড সেন্টারের পাশেই যদি ইসলামিক সেন্টার হয়, তো সেটা হবে আমেরিকার মুখে কশে চড় দেওয়া। সারাহ পেলিন থেকে শুরু করে অনেক নামজাদা রিপাবলিকান নেতা-নেত্রী পর্যন্ত এই মসজিদ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু নিউইয়র্ক শহরের মেয়র এবং অধিকাংশ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার অবস্থান ভিন্ন। যার যার ধর্মে উপাসনা করার অধিকার আমেরিকার সবার আছে। মেয়র ব্লুমবার্গ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ধর্ম পালনের অধিকারের ওপর হামলা হবে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান মূল্যবোধের ওপর হামলা। ব্লুমবার্গ বলেছেন, ৯/১১ তারিখের হামলায় যে তিন হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনেকে ছিল মুসলমান। তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতেও এই ইসলামিক সেন্টার নির্মাণে সমর্থন জানানো উচিত।
আসলে আমেরিকায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যে লক্ষণ চোখে পড়ছে, তা একটি বৃহত্তর অসুস্থতারই প্রকাশ।
অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মুখে বহিরাগত সবাইকেই শত্রু মনে হয়। ১৯৩০ সালের মহা মন্দাবস্থার পর এত বড় অর্থনৈতিক মন্দার মুখে এ দেশের মানুষ পড়েনি। আমেরিকার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এখন কর্মহীন। এ অবস্থায় প্রতিটি কর্মরত বহিরাগতকে দেখে মনে হয়, এই লোকটি না থাকলে তার চাকরিটি আমার জুটত। পশ্চিমের রাজ্যগুলোতে যেখানে কর্মহীনতা এখন রেকর্ড পরিমাণ—বহিরাগত প্রশ্নে রাজনৈতিক আবহাওয়া রীতিমতো তেতে উঠেছে। আরিজোনা রাজ্যে নতুন আইন করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে পুলিশ রাস্তায় বা কর্মস্থলে যেকোনো লোককে তার পরিচয়পত্র দেখানোর হুকুম করতে পারে। পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলে তাকে জেলে ঢোকানোর ক্ষমতা পুলিশের থাকবে। প্রধানত মেক্সিকো থেকে আসা বেআইনি বহিরাগতদের ঠেকাতেই এই আইন। অনেকেই বলছেন, বহিরাগতদের বিরুদ্ধে জনমত খেপিয়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে রক্ষণশীল রিপাবলিকান দল। তবে এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। তাঁদের অন্যতম প্রেসিডেন্ট ওবামা। তিনি বলেছেন, এই আইন ভ্রান্ত—‘মিসগাইডেড’। বহিরাগত প্রশ্নে আইন করার অধিকার একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের, এই যুক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রণালয় আরিজোনার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে।
বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের অন্য কারণ ওবামা নিজে। এই প্রথমবারের মতো একজন কালো মানুষ আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ব্যাপারটা এখনো মেনে নিতে পারছে না এ দেশের একাংশ। ওবামার উত্থানের কারণ হিসেবে তাঁরা দেশের কৃষ্ণকায় ও হিস্পানিক জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক গুরুত্বকে চিহ্নিত করেছেন। একদল মানুষ প্রধানত শ্বেতকায় ও রিপাবলিকান—গোড়া থেকেই দাবি করে আসছে ওবামা নিজেই একজন বহিরাগত। এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক জনমত গণনায় দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখনো মনে করে ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেননি। মার্কিন আইন অনুযায়ী শুধু আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিক এ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। ফলে ওবামা বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, এই দাবি তুলে রক্ষণশীল নেতারা ওবামার নির্বাচনকেই বেআইনি বলে প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
বহিরাগত প্রশ্নে অবশ্য শুধু আমেরিকায় নয়, ইউরোপেও বাতাস গরম হয়ে উঠছে। সেখানেও মুসলমানদের সঙ্গে নানা রকম ঠোকাঠুকি লাগা শুরু হয়েছে। নানা রকম আইন বানানো শুরু হয়েছে, যার লক্ষ্য দেশের মুসলমান সংখ্যালঘু। যেমন ফ্রান্সে হিজাব পরার বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে গণভোটের পর মিনারসহ মসজিদ বানানো নিষিদ্ধ হয়েছে। ডেনমার্ক ও জার্মানিতে মুসলমান ও অন্য বহিরাগতদের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে।
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা যে একধরনের ফ্যাসিবাদী মনোবৃত্তির পরিচায়ক, তাতে সন্দেহ নেই। ওবামা ও তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টি বহিরাগত ও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে নমনীয়, এই যুক্তি তুলে ধরে রিপাবলিকান দল মাঠপর্যায়ের সমর্থকদের এক ছাতার তলে আনার চেষ্টা করছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে মসজিদ বানানোর প্রস্তাব তাদের কাছে মেঘ না চাইতেই জল হয়ে এসেছে। ফলে যতটা সম্ভব, যেভাবে সম্ভব, এই ইস্যু ব্যবহার করে মুসলমান ও বহিরাগত বিরোধী মনোভাব গড়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ সপ্তাহে রক্ষণশীল পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ এক উপ-সম্পাদকীয়তে বুশ প্রশাসনের দুই সাবেক কর্মকর্তা ট্রেড সেন্টারের ভূমিকে ‘আমেরিকার আউশভিত্স’ (অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নািস জার্মানির তৈরি ইহুদিদের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ বা বন্দী নির্যাতন শিবির) বলে বর্ণনা করেছেন। সেখানে মসজিদ বা ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার বানালে তা হবে ‘আমাদের বিরুদ্ধে আরেক হামলা’। প্রায় একই কথা বলে এই মসজিদ বানানো বন্ধের দাবি তুলেছেন নিউইয়র্কের রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য পিটার কিং।
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় আমেরিকা ও ইউরোপে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ ও ‘ইসলাম ধর্ম’কে গুলিয়ে ফেলা চরম নির্বুদ্ধিতা। ইসলামের নামে তত্পর সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার যতটুকু আমেরিকা, তার চেয়ে অনেক বেশি খোদ ইসলামি দেশগুলো। পাকিস্তানের দিকে তাকালেই ছবিটি পরিষ্কার হয়। সেখানে ইসলামের নামে চরমপন্থীদের হাতে প্রায় প্রতিদিনই নিরীহ মুসলমান নারী-পুরুষ হতাহত হচ্ছে। এ ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তাই একা আমেরিকার নয়, মুসলিম দেশগুলোরও। তাদের সঙ্গে নিয়েই এই যুদ্ধে এগোতে হবে। আমেরিকার ভেতরে মুসলমানেরা যদি বৈষম্য ও সমালোচনার শিকার হয়, তার প্রভাব দেশের বাইরে মুসলমান দেশগুলোতেও পড়বে। দক্ষিণ এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের ‘মন জয়ের’ জন্য যে কূটনৈতিক উদ্যোগ আমেরিকা নিয়েছে, তারও কোনো ফল মিলবে বলে মনে হয় না।
সন্ত্রাস, তাই ইসলামই হোক বা অন্য কোনো ধর্মের আবরণে হোক, তা কারোর জন্য শুভ হতে পারে না। এই সহজ কথাটা মেনে নিয়ে আমরা সবাই যদি তার বিরুদ্ধে এক হই, এই দানবকে রোখা কঠিন হবে না।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.