শ্রদ্ধাঞ্জলি-শামসুর রাহমানের বাড়ি by সোহরাব হাসান

কেমন আছে শ্যামলীর ১ নম্বর সড়কের ছোট্ট দোতলা বাড়িটি, যেখানে কবি শামসুর রাহমান থাকতেন? তাঁর স্মৃতি ও স্বপ্নঘেরা সেই বাড়ির নিচতলার অগোছালো পাঠাগার, দোতলার লেখার টেবিল, বইপত্র সবই আছে, আছেন তাঁর স্বজনেরা—স্ত্রী জোহরা রাহমান, পুত্র ফাইয়াজ রাহমান, পুত্রবধূ টিয়া রাহমান ও আদরের দুই নাতনি। কিন্তু কবি নেই।


চার বছর ধরে বাড়িটি যেন ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কবি শামসুর রাহমান মারা গেছেন ১৭ আগস্ট ২০০৬ সালে। পিজি হাসপাতালে। তার আগে শ্যামলীর এ বাড়িটিই ছিল কবির স্থায়ী ঠিকানা।
যখন শামসুর রাহমান বেঁচে ছিলেন, এ বাড়িটি মুখর থাকত কবি-ভক্ত ও অনুরাগীদের ভিড়ে। কেউ কবিতা নিতে আসতেন, কেউ কবিকে দেখতে আসতেন। কবি-যশোপ্রার্থীরা আসতেন নিজের কবিতা শোনাতে। আবার কেউ সাহিত্যসভার দাওয়াতপত্র নিয়ে আসতেন। ‘লাজুক’ শামসুর রাহমান ভিড়ভাট্টায় খুব একটা যেতে চাইতেন না। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাসও তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন আনখমস্তক কবি। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভক্তদের অনুরোধ রক্ষা করতেন, যাকে বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা।
কবির জন্মদিনে ভক্ত-অনুরাগী ও তরুণ কবিরা আসতেন। আসতেন সংস্কৃতিসেবীরা। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সবাইকে হাসিমুখে গ্রহণ করতেন। ফুলে ফুলে ভরে যেত নিচতলার বৈঠকখানাটি। কারও হাতে থাকত কবিতার বই বা অন্য কোনো উপহার। পত্রিকা অফিস থেকে, টিভি চ্যানেল থেকে সাংবাদিকেরা আসতেন তাঁর অনুভূতি জানতে। আসতেন তাঁর প্রিয় বন্ধু-স্বজনেরা। এভাবে কখনো কখনো বাড়িটি হয়ে উঠত লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীদের তীর্থকেন্দ্র। এ রকম এক জন্মদিনে রাইটার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘কবিশ্রেষ্ঠ’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কবি বিনম্র চিত্তে সেটা গ্রহণও করেছিলেন। জানি না রাইটার্স ক্লাবের সুহূদেরা এখনো তাঁর জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে সেই বাড়িটিতে যান কি না? গেলে, তাঁর প্রিয়জনদের ভালো লাগবে।
বাড়িটি ঘিরে কবির যেমন অসংখ্য আনন্দের স্মৃতি আছে, তেমনি আছে বেদনার স্মৃতিও। মনে আছে, জোট সরকারের আমলে একবার কবিতা চাওয়ার ছলে হরকাতুল জিহাদের এক জঙ্গি তরুণ কবির ওপর হামলা চালিয়েছিল। তার উদ্যত ছোরাটি কবিপত্নী না ধরে ফেললে হয়তো বড় অঘটন ঘটতে পারত। ক্ষমতাসীনেরা হামলার ঘটনাটিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এগিয়ে আসেননি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরাও। যেন কবির ওপর হামলা হলে তাঁদের কী আসে যায়? সেই হামলাকারীর বিচার আজও হয়নি।
শামসুর রাহমানের জন্ম পুরান ঢাকায়। তাঁর শৈশব-কৈশোর ও কাব্যচর্চার একটি বড় সময় কেটেছে পুরান ঢাকার মাহুতটুলীতে। সেটি ছিল তাঁর পৈতৃক বাড়ি। তাঁর বহু কবিতায় এবং স্মৃতির ঢাকার বড় অংশজুড়ে আছে পুরান ঢাকার কথা। শামসুর রাহমানের মাহুতটুলীর এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই জম্পেশ কবিতার আড্ডা হতো। আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী ও ফজল শাহাবুদ্দীনসহ অনেক কবিবন্ধু।
আশির দশকে শামসুর রাহমান সোবহানবাগের ২২ তল্লাবাগে এসে ওঠেন। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর শ্যামলীর দোতলা বাড়িটিতে চলে যান। আমৃত্যু তিনি সেখানেই ছিলেন।
বিদেশে লেখক-কবিদের বাড়ি সংরক্ষণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে। আমাদের এখানেও নেতা-নেত্রীদের নামে কত কিছু করা হয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দলীয় লোকের নামে সড়ক ও স্থাপনা করা হয়। কিন্তু দেশের প্রধান কবি, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’র রচয়িতার স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। তাঁর নামে ঢাকা শহরের কোনো সড়ক নেই। স্থাপনা নেই। এ ব্যাপারে সরকার বা ঢাকা সিটি করপোরেশনের কি কোনো দায়িত্ব নেই?
আমরা জানি, শামসুর রাহমানের বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল। ছিল দেশি-বিদেশি সাহিত্যের বিপুল ভান্ডার। দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পুরস্কারে অভিষিক্ত হয়েছেন। অনেক খ্যাতনামা লেখক তাঁকে স্বাক্ষরসহ বই উপহার দিয়েছেন। সেসবও আমাদের পরম সম্পদ। এসব পদক ও বই সংরক্ষণ করার জন্য যে আর্থিক সামর্থ্য থাকা দরকার, তা তাঁর পরিবারের নেই।
শেষ জীবনে অনেকগুলো বছর কবি শুধু লেখার আয় দিয়েই চলতেন। ফলে সঞ্চয় বলতে কিছু ছিল না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁর আদর্শের দল ক্ষমতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক ছিল। গত আওয়ামী লীগ আমলে কবির চিকিৎসার জন্য তিনি অনেক কিছু করেছিলেন। এখন কবি নেই। তাঁর স্মৃতিরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলে সেটি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি সমগ্র জাতির সম্মান ও শ্রদ্ধার নিদর্শন হয়ে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.