মৃদুকণ্ঠ-বাজেট ও উন্নয়ন দর্শন by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

বাজেট নিয়ে প্রতিবছরের মতো এবারও অনেক আলাপ-সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গোলটেবিল, সেমিনার, টক শো প্রভৃতির মাধ্যমে সুপারিশমালা উঠে এসেছে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী চেম্বার বা সমিতি নিজ নিজ সেক্টর থেকে প্রস্তাব রেখেছে।


কৃষকদের পক্ষ থেকে একটি কৃষি বাজেট প্রস্তাবও সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবছর বাজেটে এসব প্রস্তাব বা সুপারিশমালার কতটা প্রতিফলন ঘটে, সে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো সমীক্ষা হয়েছে বলে জানা নেই। তবে ধারণা করা হয়, বাজেটে এ ধরনের জনমতের তেমন প্রতিফলন ঘটে না। কারণ বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সুপারিশকরণ প্রক্রিয়ার কোনো সংযোগ নেই। দুটি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে। দুটির সংযোগ ঘটে না কোনো বিন্দুতে। সামান্য যেটুকু প্রতিফলন দেখা যায়, তা মূলত অর্থমন্ত্রীর ইন্টারভেনশনে। বাজেট প্রণয়নে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন না হলে সুপারিশ বিবেচনা প্রক্রিয়া দূরেই থেকে যাবে।
এ বছর বাজেট সম্পর্কিত আলোচনায় প্রধান যে বিষয়গুলো উচ্চারিত হয়েছে, সেগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করা যায়। কৃষি খাতের বাজেট আলোচনায় প্রতিবারের মতো এবারও কৃষকরা অংশ নিয়েছেন। শহুরে আলোচনায় কৃষির কথা কম হলেও উচ্চারিত হয়েছে। এ বছর কৃষক ও কৃষি বন্ধুদের প্রধান দাবি এসেছে পৃথক কৃষি বাজেট ঘোষণার। তাঁদের যুক্তি হলো, রেল মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রতিবেশী দেশ ভারতে পৃথকভাবে তৈরি হয় এবং রেলমন্ত্রী সে বাজেট উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর অনেক দেশে গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য স্বতন্ত্র বাজেট প্রস্তুতের নজির রয়েছে। কৃষি যেহেতু বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান খাত, সেহেতু কৃষির জন্য পৃথক বাজেট তৈরি করা সমীচীন। এতে এ খাত যথাযথ গুরুত্ব পাবে। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি বাজেট প্রস্তুত করবে এবং কৃষিমন্ত্রী তা সংসদে উপস্থাপন করবেন।
কৃষকদের আরেকটি বড় দাবি হলো উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি। অনেক পরিশ্রম করে তাঁরা ফলন বাড়িয়েছেন। অথচ ফসল বিক্রি করে উৎপাদন খরচটাও উঠে আসে না। চাল কিনে খেতে হয় না, এটুকুই তাঁদের প্রাপ্তি। বাড়তি ফসল বিক্রি করে সংসারের অন্যান্য কেনাকাটা হয়ে ওঠে না। এ জন্য তাঁদের জোর দাবি, সরকার যেন উপযুক্ত মূল্যে তাঁদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করে। এ বছর ধান-চাল সংগ্রহের ক্রয়মূল্য রাখা হয়েছে কেজিপ্রতি ধান ১৮ ও চাল ২৮ টাকা। এই মূল্য উৎপাদন খরচ মেটায়। কিন্তু উৎপাদনকারী কৃষক তো নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করছেন না। সরকার ক্রয় করছে চাতাল মালিক তথা মজুদদারদের কাছ থেকে। মজুদদাররা কৃষককে ধানের দাম কেজিপ্রতি ১২ টাকার বেশি দিচ্ছেন না। সরকার যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে সরকার নির্ধারিত ক্রয়মূল্য কৃষক পেতে পারেন। কিন্তু সরকারের সে সক্ষমতা নেই বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার খাদ্যশস্য ক্রয় এজেন্ট নিয়োগ করতে পারে। চাতাল মালিকরাও এজেন্ট হওয়ার যোগ্য হবেন। সরকার ঘোষিত ক্রয়মূল্যে নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা কৃষকের কাছ থেকে যথাবিহিত রসিদ দিয়ে ধান-চাল ক্রয় করবেন। সংগৃহীত শস্য সরকার কিনবে এবং সংগ্রহ খরচ বাবদ এজেন্ট কমিশন পাবেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার চাতাল মালিক অথবা মজুদদারদের কাছ থেকে ধান-চালের ক্রয়মূল্য ঘোষণার সময় মজুদদাররা সর্বনিম্ন কত দামে কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করবে তাও নির্ধারণ করে দেবে। সরকারের ক্রয়মূল্য ২০ টাকা হলে কৃষকের বিক্রয়মূল্য কোনোক্রমেই ১৬-১৭ টাকার নিচে হবে না। চাতাল মালিক রসিদ দিয়ে নগদ মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে নির্ধারিত নিম্নতম মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন।
গ্রামীণ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে না উঠলে কৃষি উৎপাদনকারীরা ঠকতেই থাকবেন। এ বিষয়ে দাবি উঠলেও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণে সমস্যা রয়ে গেছে। গত দু-তিন বছর বাজেট বক্তৃতায় পল্লী এলাকায় কয়েকটি বিপণনকেন্দ্র বা মজুদকেন্দ্র গঠনের উল্লেখ ছিল। টাকার প্রবেশদ্বারে একটি কেন্দ্রীয় বিপণন কেন্দ্র তৈরির কথাও উল্লেখ ছিল। এ বিষয়ে অগ্রগতি জানা নেই। আরো কমপ্রিহেনসিভ প্রকল্প প্রণয়ন প্রয়োজন, যা বাজেটে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। জার্মান সহায়তায় অনেক বছর আগে 'সগরিব' প্রকল্পের আওতায় ১১৪টি গ্রামীণ গুদাম নির্মাণ করা হয়েছিল কৃষকদের উৎপাদিত শস্য জমা রাখার জন্য। গুদামগুলো বিআরডিবির অধীনে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বলে শোনা যায়। গরিব দেশে সম্পদের এমন অপচয় দুঃখজনক। এই ১১৪টি গুদাম মেরামত করে ব্যবহারোপযোগী করা হোক এবং বাজেটে এ জন্য বরাদ্দ রাখা হোক। 'গ্রামীণ বিপণন সংস্থা' নামে একটি নতুন সংস্থা গঠন করে গুদামগুলো ওই সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা যায়। একটি দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় পর্যাপ্ত পল্লী গুদাম নির্মাণ করা যায়। সমবায়ভিত্তিক পল্লী বিপণন প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে পল্লী গুদামগুলো সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
কৃষি বাজেট বিষয়ে এবারকার সবচেয়ে জোরালো দাবি সম্ভবত ভর্তুকি নিয়ে। যুক্তি দেওয়া হয়, গত তিন-চার বছরের কৃষিতে অধিক ফলনের মূলে ছিল ভর্তুকি। সারের মূল্যে ভর্তুকি ও ডিজেলে ভর্তুকি কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করেছে। এরই মধ্যে আবার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতির দামও বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে ভর্তুকিও বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষিজীবীরা। নিদেনপক্ষে ভর্তুকির বর্তমান পরিমাণ বজায় রাখতে হবে। অন্যান্য বিষয়ে বাজেট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ। শিল্প ও সেবা খাত মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বিদ্যুতের অভাবে। নতুন শিল্প স্থাপন থমকে গেছে, এমনকি চলমান শিল্প স্থাপনায়ও উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে বিদ্যুতের অভাবে। বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে আবাসন খাত স্থবির হয়ে পড়েছে। পল্লী বিদ্যুতের কথা না বলাই ভালো। শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ এতই নাজুক যে দিনরাত পালাক্রমে লোডশোডিং চলতে থাকে। বিদ্যুতের অভাবে শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও হুমকির মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বিপুল বরাদ্দ এবং বরাদ্দের সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবহার ছাড়া সমস্যাচক্র থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে মিনি পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা অনেকে পছন্দ করেনি। তবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন বাস্তবসম্মত ছিল। এর কোনো শর্টটার্ম বিকল্প ছিল না। এ ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আরো খারাপ হতো। তবে তিন বছর মেয়াদি রেন্টাল চুক্তি আর বাড়ানো উচিত হবে না। দরকষাকষির মাধ্যমে ক্রয়মূল্য যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে কমানো গেলে নতুন চুক্তি হতে পারে।
গত তিন বছরে বড় পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এটি সরকারের একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। এবারের বাজেটে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যথাযথ বরাদ্দ রাখা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে প্লান্ট স্থাপনে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করতে হবে।
বাজেটের একটি দর্শন থাকে। দর্শনটি হওয়া উচিত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংগত বণ্টনব্যবস্থা। দেশের বেশির ভাগ সম্পদ ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। এই কোটারিকে আঘাত করার ক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ তারা সরকার তথা রাজনীতিকে বেষ্টন করে রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পল্লী এলাকার স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর সম্পদ সৃষ্টি ও বর্ধনের প্রয়াস নেওয়া একটি ভালো কৌশল হতে পারে। নিরাপত্তাবলয়ে সহায়তা দিয়ে সম্পদ সৃষ্টি তেমন হয় না। সঙ্গে সঙ্গে পল্লীর ক্ষুদ্র বিনিয়োগ, ব্যবসা ও কৃষিতে অর্থায়ন সম্পদ সৃষ্টির সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তোলে। এটাই হতে পারে এবারের বাজেটের উন্নয়ন দর্শন।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.