বাজেট ২০১২-১৩-বাজেটে রাজনৈতিক প্রকল্পের অত্যাচার by জাহাঙ্গীর শাহ

চলতি জুন মাসে মিরপুর-বিমানবন্দর সড়কে ফ্লাইওভার এবং বনানী রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪৭ শতাংশ। অগত্যা মেয়াদ বাড়াতে হলো এক বছর। খরচও বাড়ল সমানতালে।


২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় এর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৯১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্পটি সংশোধন করে খরচ ১৬৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩৬০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
২০০৭ সালে নেওয়া হয় রংপুর বেনারসি পল্লি উন্নয়ন প্রকল্প। এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি শেষ করার কথা এই জুনে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৪ লাখ টাকা। আগামী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আবার ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, প্রকল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে বছর বছর বরাদ্দ দেওয়া হবে, খরচ হবে না।
আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কড়াইকান্দি-বাঞ্ছারামপুর-জীবনগঞ্জ সড়ক নির্মাণের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বছরের পর বছর এডিপিতে রয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পটিতে প্রায় ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এভাবে বছরের পর বছর রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। আবার নজরদারির অভাবে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অথচ প্রভাবশালীদের চাপে বরাদ্দ ঠিকই দিতে হচ্ছে। প্রকল্প নির্বাচনেও গলদ রয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবনা মূল্যায়ন না করেই অনুমোদন দেওয়ায় বছরের পর বছর এসব প্রকল্প এডিপিতে রয়ে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে ৩০২টি প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯২টি প্রকল্প শেষ হচ্ছে। ১১০টি প্রকল্প আগামী এডিপিতে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এডিপি বাস্তবায়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছরে প্রকল্প নির্বাচন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। গতানুগতিকভাবেই চলছে এডিপি বাস্তবায়ন। প্রকল্প নির্বাচনেই গলদ রয়েছে।
প্রকল্পের অত্যাচার: প্রতিবছর এডিপিতে থাকে হাজার খানেক অনুমোদিত ও বরাদ্দযুক্ত প্রকল্প। প্রায় সমসংখ্যক প্রকল্প থাকে অননুমোদিত ও বরাদ্দহীনভাবে। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই এসব প্রকল্প এডিপিতে রাখা হয়। তারপর বছরজুড়ে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়, সংশোধিত এডিপি ঢুকে পড়ে। এভাবেই প্রকল্পভারে ন্যুব্জ এখন এডিপি।
২০১১-১২ অর্থবছরের চলতি এডিপিতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ বছর মূল এডিপিতে এক হাজার ৩৯টি প্রকল্প ছিল। কিন্তু ৮০০টি প্রকল্প বরাদ্দহীন ও অননুমোদিতভাবে এডিপিতে রাখা হয়েছিল। এই প্রকল্পগুলো থেকে ১৮৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া এবং পুরোনো প্রকল্পে বরাদ্দ কমে যাওয়া।
আগামী অর্থবছরে এডিপির জন্য ৩৫টি নতুন প্রকল্পসহ মোট এক হাজার ৩৭টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে বরাদ্দহীন অননুমোদিত প্রকল্প হিসেবে আরও এক হাজার ৪৭টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মূলত রাজনৈতিক অর্থাৎ মন্ত্রী-সাংসদ, প্রভাবশালীদের চাপে এডিপিতে বরাদ্দহীন ও অননুমোদিতভাবে নতুন প্রকল্প এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয় পরিকল্পনা কমিশন। যেমন, শুধু যোগাযোগ খাতেই এবার ১৭০টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে। এর মধ্যে ৯৪টি প্রকল্প বরাদ্দহীন ও অননুমোদিত প্রকল্প হিসেবে এডিপিতে রাখা হয়। অধিকাংশ প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি না করেই শুধু প্রকল্পের শিরোনাম দিয়েই এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিদের চাপে রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পই বেশি বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
বরাদ্দহীন ও অনুমোদিত এসব প্রকল্প অনুমোদন দিতে পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। টাস্কফোর্স অনুমোদিত ও বরাদ্দহীন প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (এনইসি) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করবে। এর আগে অর্থমন্ত্রী টাস্কফোর্স গঠনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীকে আধা সরকারিপত্র (ডিও) দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত পরিকল্পনাসচিব ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর ঢালাওভাবে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হবে না। সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প বাছাই করা হবে। এ জন্য পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স বছরজুড়ে কাজ করবে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে বলেন, এডিপি নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন কতটা কার্যকর হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। রাজনৈতিক চাপ সামলে টাস্কফোর্স স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, তাও বিবেচনায় আনতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী এডিপি বাস্তবায়নে যৌক্তিক কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
অব্যবহূত বিদেশি অর্থ: ২৪৬ কোটি টাকার আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌবন্দর স্থাপন প্রকল্পের মধ্যে বিদেশি সহায়তা হিসেবে রয়েছে ২১৯ কোটি টাকা। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে কোনো টাকা ছাড় না হওয়ায় গত দেড় বছরে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। আগামী বছর এই প্রকল্পে ৩৩ কোটি টাকা বিদেশি সহায়তা খরচের হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছে।
নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হবে এক হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সহায়তা হিসেবে আসার কথা ৯৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে কোনো বিদেশি সহায়তা অর্থ ব্যবহার সম্ভব হয়নি। তাই প্রকল্পের কোনো টাকা খরচ হয়নি।
এভাবে বিদেশি সহায়তার টাকা ব্যবহার করতে না পারায় এডিপিভুক্ত অসংখ্য প্রকল্প থমকে গেছে। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সহজে ব্যয় করা যায় বলে বিদেশি সহায়তার চেয়ে দেশজ অর্থের প্রকল্পগুলোই বাস্তবায়ন করতে বেশি আগ্রহী।
চলতি অর্থবছরে মূল এডিপিতে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই সহায়তার মাত্র সাত হাজার ১৩৭ কোটি টাকা খরচ করা সম্ভব হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-এপ্রিল মাসে মোট প্রতিশ্রুতির মাত্র ৩৮ শতাংশ অর্থ ছাড় করেছে উন্নয়ন-সহযোগীরা। অর্থবছরের এই সময়ে দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে ৪২৮ কোটি ২৪ লাখ ডলার। কিন্তু ছাড় হয়েছে মাত্র ১৬৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এই সময়ে সুদ-আসলবাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৮০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। ফলে প্রকৃত প্রাপ্তি দাঁড়িয়েছে ৮৪ কোটি ডলার।
এডিপি চলছে গতানুগতিক: চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। এই বাস্তবায়নের হার গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১০-১১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল ৫৮ শতাংশ, এর আগের বছর এই হার ছিল ৫৯ শতাংশ।

No comments

Powered by Blogger.