চারদিক-সুকান্ত: বিদ্রোহের দিনপঞ্জি-লেখক by ফারুক ওয়াসিফ

কবির চেহারা বুঝি এমন হয়? গালে হাত দিয়ে বসে, হাসি হাসি মুখ। ঠোঁটের ওপরে সদ্য গোঁফ ওঠা কালো রেখা। সুকান্তের এ ছাড়া আর কোনো ছবি আমরা পাইনি। তাঁকে চিনতে তাই সেই বিষণ্ন হাসিমাখা মুখের দিকেই আমাদের তাকাতে হবে। কিন্তু সেই মুখের গভীরে যেন আরও কার কার মুখচ্ছবি ভাসে।


সেটা ছিল ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের শহীদ হওয়ার যুগ। সেটা ছিল নজরুলের বিদ্রোহী উত্থানের যুগ, নেতাজি সুভাষ বসুর ফেরার হওয়ার যুগ। চিরকালের বিপ্লবীরা, চিরকালের শহীদেরা বুঝি এমনই হন। তাঁদের মুখে শান্ত, কোমল, অপাপবিদ্ধ সংকল্পের ছায়া। বুকের আগুনে সময়কে তাঁরা আরও শুদ্ধ করে দিয়ে যান। তাই তিনি লেখেন, ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,/আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে’। (১৯৪৬)
তিনি চেয়েছেন বিদ্রোহ, চেয়েছেন এই সমাজসংসারের খোল ও নলচে একত্রে বদলানোর দিন। মাত্র বিশ বছর দশ মাস বয়সে জরজর দেহ ফেলে চলে গেলেও অমর হয়ে গেছে তাঁর কবিতা। তাঁর আর ক্ষয় নেই। তাঁকে পাঠ করে সেই অবিনাশী আগুনের ছোঁয়া পাই। সেই আগুন যুগে যুগে জনপুঞ্জের ভেতর থেকে একটি একটি তরুণকে ইতিহাস ডাক পাঠায়। কেননা, তরুণই প্রথম টের পায় তার মুক্তিকে আটকে রাখে অন্যায়-অসম ব্যবস্থা। এখনো তরুণের মুখেই নায়কের আভা খোঁজে আমাদের সমাজ। তাই ইতিহাসের তরঙ্গ ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, নজরুল, সুকান্তদের তুলে নিয়ে যায়। তরুণের প্রাণের দাম ছাড়া পরিবর্তন আর সৃষ্টির বীজ কোথায় কবে উপ্ত হয়েছে?
কবিতা আর বিপ্লব—এই এক জোড়া শালিক তাঁর রক্তের ভেতর ধুমিয়ে আলোবাদ্যির উৎসব জাগিয়েছিল।
সময় কারও কাছে মাটির গভীরে উদ্ভিদের শেকড় ছড়ানোর মতো ধীর ও নিঃশব্দ। কিন্তু কারও কারও কাছে সময় দেখা দেয় ঝড়-বিজলি-বারুদের তীব্রতা আর গতি নিয়ে। সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সময়কে সে রকম তীব্রতাতেই পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, বাংলার দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ নর-নারী-শিশুর মৃত্যু সইতে হচ্ছে, ওদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ব্রিটিশবিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ঢেউ, চলছে তেভাগা আন্দোলন, ঘটছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দেশবিভাগের ধাক্কায় মানচিত্র কাঁপছে, মানুষ কাঁপছে, সমাজ ভাঙছে। সেই ভাঙাগড়ার মধ্যে কবির হূদয় স্থির থাকতে পারেনি। তাই লিখে যান, ‘ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ,/আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।’ (বিক্ষোভ, ঘুম নেই)
সুকান্তের কবিতার চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা তাই কেবল তাঁর মনের চাঞ্চল্য নয়, সেটা তাঁর সময়েরই উত্তেজনা। তাঁর বয়সের বিবেচনা এখানে প্রধান নয়। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের পটভূমিতে যেমন নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেন, তেমনি সুকান্ত লেখেন তাঁর ‘ছাড়পত্র’, ‘আগ্নেয়গিরি’, ‘হে পৃথিবী’র মতো কবিতা। দুর্ভিক্ষের বাংলায় অভূতপূর্ব তাঁর সেই উপমা ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। ক্ষুধিত পাষাণ হয়ে যাওয়া মানুষের মনে এই কবিতা কেবল কবিতা নয়, প্রচণ্ড ক্ষোভ আর প্রতিবাদ থেকে উঠে আসা সত্যভাষণ। সুকান্ত তাই নিছক কবি নন, সময়ের কবি। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সুকান্তের মধ্যে দেখেছেন ‘প্রতিশ্রুতি’ আর কবি বিষ্ণু দে দেখেছেন ‘পরিণতি’। কিন্তু যে জীবনাবেগ তাঁর কবিতার মধ্যে শরীরের ভেতর শিরা-উপশিরার মতো বইছিল তাকে পরিণতি আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বোঝা যাবে না, তা ‘ঘটনা’। বাংলা সাহিত্যে সুকান্তের আবির্ভাব তাই একটি ঘটনা—যা একবারই কেবল ঘটে।
সময়ের বিষ শিবের মতো পান করে যিনি অমৃত ফলাচ্ছেন, অথচ মনের ভেতর তিনি একা। প্রেম হারিয়ে যাচ্ছে, অসুস্থ মা মারা যাচ্ছেন, দারিদ্র্য এমনভাবে ঘিরে ধরছে যে তিনি বন্ধুকে লিখতে বাধ্য হন, ‘কি করে ভুলি, দেহ আর মনে আমি দুর্বল: একান্ত অসহায় আমি? আমার প্রেম সম্পর্কে সম্প্রতি আমি উদাসীন। অর্থোপার্জন সম্পর্কেই কেবল আগ্রহশীল। কেবলই অনুভব করছে টাকার প্রয়োজন...একখানাও জামা নেই...অর্থের অভাবে কেবলই নিরর্থক মনে হচ্ছে জীবনটা। (সুকান্ত: জীবনকথা। সুকান্ত রচনাসমগ্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা)
অথচ ইনিই সেই কবি, যিনি লিখেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,’। হ্যাঁ, সেই ঝুঁকি তিনি আমৃত্যুই নিয়েছিলেন। আর বরণ করেছিলেন জীবনের থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরস্কার: মৃত্যু। যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে, যেন পুড়ে পুড়ে শেষ হলো একটি আগুনের জীবন। ১৯২৬-এর ১৫ আগস্ট জন্মে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে মৃত্যু তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল। অথচ কী আশ্চর্য, মৃত্যুদিনে তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায় চলছিল দাঙ্গা।
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী, কিশোর সংগঠন কিশোর বাহিনীর সংগঠক সুকান্তর কবিতা আর জীবন তাই একাকার। মৃদুস্বরে, ধ্যানের ভঙ্গিমায় যে কবিতা লিখিত হয় তাও যেমন শিল্প; তেমনি উচ্চকিত ভাষায় অস্তিত্ব নিংড়ে যে ভাষা ওঠে তাও শিল্প। সুকান্ত তা বোঝালেন। এমনকি ওই বয়সে, শ্লেষের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন ঔপনিবেশিক ‘ইউরোপের উদ্দেশ্যে’, ‘ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন/এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন;’ (ইউরোপের উদ্দেশ্যে)।
তরুণের আয়ুনাশের মতো অপচয় আর নাই। তরুণ কবির মৃত্যুর ক্ষতি তার চেয়েও বেশি। যেমন কিটসের মৃত্যু, যেমন ডিরোজিওর মৃত্যু। জীবন হিসেবে যতই অসম্পূর্ণ হোক, কৃতিত্বের বিচারে সুকান্তের কবিতা এক নতুন ধারার কবিতার সূচনা।
সব কবিই যেন গোপনে তাঁর কবিতার ভেতরে রেখে যান নিজের বিদায়লিপি—এপিটাফ। সুকান্তও লিখেছিলেন, ‘চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,... অবশেষে সব কাজ সেরে/আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হবো ইতিহাস।’
আজ, সত্যিই তিনি ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.