মানসিক স্বাস্থ্য-পরিবারে আর রাজনীতিতে মানসিক খেলা by মেহতাব খানম

কিছুদিন থেকে স্বামী অঙ্কুরকে অন্যমনস্ক দেখছে তার স্ত্রী মিতা। স্ত্রীর প্রতি তার আগ্রহ কমে গেছে, অফিস থেকে প্রতিদিনই দেরি করে বাড়ি ফিরছে। একদিন অঙ্কুর ছুটির দিনে জরুরি কিছু কিনতে দোকানে গিয়েছে মোবাইল ফোনটি ভুল করে বাড়িতে রেখে।


মিতা কৌতূহলবশত ফোনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সেখানে বেশ কিছু মেসেজ দেখতে পেল, যা থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেল অঙ্কুর অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। মিতা অপেক্ষা করতে থাকল কখন অঙ্কুর আসবে আর মিতা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করবে, কারণ এ ধরনের ঘটনা আরও দুবার ঘটেছে। মিতা প্রতিবারই আশা করে, অঙ্কুর আর এসব করবে না, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। মিতা কি তাহলে অঙ্কুরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে? কিন্তু সেটা ভাবাও তো খুব কষ্টকর! এত মিথ্যাচার, বিশ্বাসভঙ্গের পরও মিতার মনে হয়, এখনো সে অঙ্কুরকে খুব ভালোবাসে। এ ছাড়া ওদের একমাত্র কন্যাসন্তান জয়া এখন বয়ঃসন্ধিতে রয়েছে। ওর এই সংবেদনশীল বয়সে বাবা-মা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে জয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অঙ্কুর বাড়ি ফেরার পর মিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এভাবে বারবার বিশ্বাস ভঙ্গ করলে সে এত দুঃখ সইবে কেমন করে? এ কথা শুনে অঙ্কুর নিমিষেই রেগে গিয়ে বলল, মিতার এসব ন্যাকামো তার একেবারে পছন্দ নয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। অঙ্কুরের যা খুশি তা-ই সে করবে। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বা ব্যক্তিগত মেসেজ দেখার অধিকার কারও নেই। এই কথাগুলো শুনে মিতা অঙ্কুরের পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকল, সে অঙ্কুরকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে, তাকে ছাড়া বাঁচবে না। এতে অঙ্কুর আরও রেগে গিয়ে মিতাকে নানাভাবে দোষারোপ করতে থাকল। এর মধ্যে পাশের ঘর থেকে জয়া এসে দাঁড়িয়েছে। সে এই দৃশ্যটি দেখে খুব বিরক্ত। একসময় জয়া রেগে গিয়ে অঙ্কুরকে বলল, সে বাবা ও স্বামী দুটো ভূমিকাতেই ব্যর্থ হয়েছে, কারণ পরিবারের প্রতি কোনো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। এই কথাগুলো শুনে মিতার মনে হলো জয়া তার সীমা লঙ্ঘন করছে। সে অঙ্কুরের পা ছেড়ে দিয়ে উচ্চ স্বরে বলতে থাকল, মা-বাবার ব্যাপারে জয়ার আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং বাবার সঙ্গে সন্তানের এতটা বেয়াদবি করা মোটেও উচিত নয়। এ কথা শুনে জয়া কাঁদতে থাকল এবং দুঃখ করে বলতে থাকল, সে আর এই পরিবেশে থাকতে চায় না, ওকে যেন কোনো হোস্টেলে রেখে আসা হয়। জয়াকে কাঁদতে দেখে অঙ্কুর আবার রেগে গিয়ে মিতাকে বলল, জয়ার সঙ্গে এ রকম দুর্ব্যবহার করাটা মিতার মোটেও উচিত হয়নি। এই কথা শুনে মিতা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল এবং বলল, বাবা-মেয়ে দুজনকেই ছেড়ে, এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে সে। তার আর বুঝতে বাকি নেই যে ওরা দুজনই অকৃতজ্ঞ এবং বাড়িতে তার আর কোনো প্রয়োজন নেই। মিতা নিজের রাস্তা নিজেই বেছে নেবে।
ওপরের ঘটনাটির মতো অনেক ঘটনা প্রায়ই পরিবারের ভেতর ঘটে। ঘটনার চরিত্রগুলোর নামগুলো কাল্পনিক। এই ঘটনার চরিত্রগুলো যা আচরণ করেছে, তা হয়েছে ওদের প্রত্যেকের অবচেতন মনের প্রভাবে। ঘটনাটি চলার সময়ে চরিত্রগুলোর যুক্তিবাদী সত্তা সাময়িকভাবে হারিয়ে গেছে। তাদের ভেতরের যুক্তিহীন অবুঝ, আবেগপ্রবণ সত্তা এবং সমালোচনামুখর ও নিয়ন্ত্রণকারী সত্তাগুলো ওদের আচরণের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে তিনটি চরিত্র যা যা করবে বলেছে পরবর্তী সময়ে সেই অনুযায়ী আচরণ করবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এটি সহজেই অনুমেয় অঙ্কুর, মিতা বা জয়া—কেউ কিন্তু সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা আবেগতাড়িত হয়ে মনের অজান্তেই কতগুলো কৌশল অবলম্বন করি। এই কৌশলগুলো সমস্যার সরাসরি সমাধান না করলেও, আমরা আপাত সমাধান হিসেবে গণ্য করে বারবার প্রয়োগ করতে থাকি। আর তখনই আমরা মানসিক খেলায় মেতে উঠি এবং চক্রাকারে ভূমিকা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই খেলা চলতে থাকে আমাদের জীবনে।
যুক্তরাষ্ট্রের মনোরোগ চিকিৎসক এরিক বার্ন তাঁর গেমস পিপল প্লে বইটিতে চমৎকারভাবে এই মানসিক খেলার বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, আমরা সমাজে চলতে গিয়ে প্রায় বেশির ভাগ সময়ই এই খেলায় অংশ নিই, তবে তা মোটেও সচেতনভাবে নয়। কার্পম্যান একটি ত্রিভুজের তিনটি কোনায় থাকা তিনটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আমাদের এই মানসিক খেলাকে উপস্থাপন করেছেন। এই ভূমিকা তিনটি হচ্ছে—আক্রমণকারী বা পারসেকিউটর, ভিকটিম এবং ত্রাণকর্তা বা রেসকিউয়ার।
ওপরে বর্ণিত ঘটনায় আমরা এই মানসিক খেলা দেখতে পেয়েছি। অঙ্কুর, মিতা ও জয়া নিজেদের অজান্তেই এই তিনটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং তাদের ভূমিকা পরিবর্তনও করেছে। অঙ্কুর বাড়িতে ফেরার পর মিতা প্রথমে ভিকটিমের জায়গা থেকে কথা শুরু করেছিল আর অঙ্কুরের ভূমিকাটি ছিল আক্রমণকারীর। এই অবস্থা চলাকালে জয়া সেখানে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মিতা তখন ভিকটিমের ভূমিকাটি ছেড়ে দিয়ে জয়াকে আক্রমণ করে বসল। জয়া তখন তার ভূমিকা পরিবর্তন করে ভিকটিমে রূপান্তরিত হলো। এরপর অঙ্কুর জয়াকে সমর্থন জানাতে গিয়ে ত্রাণকর্তার জায়গা থেকে প্রতিক্রিয়া করল। আর মিতা আবার ফিরে গেল ভিকটিমের অবস্থানে। এভাবে খেলা চক্রাকারে চলতে থাকে, যতক্ষণ খেলোয়াড়েরা সেই পরিস্থিতি ত্যাগ না করে। এখানে সব সময় তিনজন মানুষই থাকতে হবে এমন কথা নেই, দুজন কিংবা তিনের অধিক মানুষও থাকতে পারে। তবে এই মানসিক খেলার পরিণতিতে সবাই প্রচণ্ড অশান্তি নিয়ে পরিস্থিতি ত্যাগ করে। এরিক বার্ন এই মানসিক খেলাগুলোর সুন্দর নাম দিয়েছেন: আক্রমণকারীর ভূমিকায় একটি খেলার নাম, ‘নাউ আই হ্যাভ নট ইউ সান অব বিচ’, ভিকটিমের ভূমিকায় খেলার নাম হচ্ছে, ‘পুওর মি’ আর উদ্ধারকারীর ভূমিকায় খেলার নাম হচ্ছে, ‘আই অ্যাম অনলি ট্রাইং টু হেলপ ইউ।’ এই খেলাগুলো পরিবারের অভ্যন্তরে আমরা প্রায়ই খেলে থাকি। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রী এবং অভিভাবক আর সন্তানদের মধ্যে অহরহ এই খেলাগুলো চলতে থাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনেও এই খেলাগুলো চলতে দেখা যায়। দুটি বড় দলের যেটি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা দখল করে, তারা প্রতিনিয়ত অন্য দলটিকে আক্রমণ করতে থাকে। পরাজিত দল অতীতে কী কী ভুল এবং অন্যায় করেছে তার তালিকা দিতে দিতেই পাঁচ বছর সময় কাটিয়ে দেয়। এ ছাড়া তারাই জনগণের একমাত্র ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করে আত্মতুষ্টি লাভ করে। আর যারা ক্ষমতায় বসতে পারে না তারা ‘পুওর মি’ খেলা শুরু করে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, ষড়যন্ত্র করে তাদের হারানো হয়েছে, সরকারি দল বর্তমানে তাদের ওপর অবিচার করছে, নির্বাচিত হলে তারা সবকিছু ঠিক করে দিতে পারত ইত্যাদি বলে সবার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে। আবার ক্ষমতায় থাকা দলকে নানাভাবে দোষারোপ করে আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করে। এ ছাড়া তৃতীয় একটি জনগোষ্ঠী, যারা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কোনোরকম বস্তুনিষ্ঠতার পরোয়া না করে কেউ সরকারি দলকে এবং কেউ বিরোধী দলের উদ্ধারকারী হিসেবে অন্ধভাবে সমর্থন জোগাতে থাকে। এই চর্চা চলছে বহু বছর থেকেই। সাধারণ মানুষ এই বড় দুটি দলের খেলার নীরব দর্শক হিসেবে নিজেদের জিম্মি মনে করে ‘পুওর মি’ খেলায় লিপ্ত হয়। পরিবার ও রাজনীতির অঙ্গনের মানসিক খেলার মধ্যে লক্ষণীয় পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এই খেলা সম্পূর্ণ অবচেতন মনের দ্বারা পরিচালিত হয় আর রাজনীতিতে কিছুটা সচেতনতা রেখে দলের লোকেরা এবং তাদের সমর্থকেরা এই খেলাগুলো খেলে থাকে। তবে দুই ক্ষেত্রেই খেলায় অংশগ্রহণ করে আমরা কিছু সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা পেয়ে থাকি। তবে এই খেলার পরিণতি যেহেতু সুখকর নয়, আমাদের উচিত হবে খেলা বর্জন করে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ফলপ্রসূ, সৎ এবং সুস্থ জীবন যাপন করা।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে খেলাটি বেশি ঘটে তা হচ্ছে, ‘ইফ ইট ওয়্যার নট ফর ইউ’ অর্থাৎ ‘তুমি না চাইলে তো আমি এটা করতাম না।’ আমার কাছে সাহায্য চাইতে আসা অনেক মেয়েই বলেন, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আপত্তির কারণে তাঁরা চাকরি করেননি এবং এটা নিয়ে তাঁর সারা জীবন অনেক মানসিক কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়েছে। এটা ঠিক, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েরা স্বাধীনভাবে তাঁদের মত প্রকাশের সাহস খুঁজে পান না। তবে স্ত্রীরা যদি ভালো করে ভেবে দেখেন তাহলে হয়তো বুঝতে পারবেন শুধু স্বামী বা অন্যদের বাধার কারণে নয়, তিনি নিজেও এ ব্যাপারে নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ নেননি। আর নিজের চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নিতে না পারার কারণেই দোষারোপ শুরু হয় এবং পরে এ থেকে মানসিক খেলাগুলো শুরু হয়ে যায়। অনেক মেয়ে মাদকাসক্ত ছেলেদের বিয়ে করেন নিজেদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় দেখতে চান বলে। কিন্তু আসক্তি এমন একটি রোগ, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে রোগীকেই সবচেয়ে আন্তরিক হতে হয়। ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করতে গিয়ে স্ত্রী ক্লান্ত হয়ে পড়ে আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং স্বামী তখন ভিকটিমের জায়গা থেকে আবেদন করতে থাকেন যে মাদক ছেড়ে দিতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন এবং একটু সহযোগিতা পেলেই তা পারবেন। কিন্তু দেখা যায়, স্বামীর আসক্তি রয়েই যাচ্ছে। এরপর স্ত্রী ভিকটিমের জায়গায় গিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন এবং স্বামী তখন আক্রমণকারীর ভূমিকা নিয়ে স্ত্রীকে বলেন, তাঁর রূঢ় আচরণের কারণেই স্বামী মাদক ছাড়তে পারছেন না। এভাবে দুজনের মানসিক খেলা অব্যাহত থাকে। অথচ দুজনেই যদি সচেতন হয়ে তাঁদের সিদ্ধান্তের পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিতেন, তাহলে স্ত্রী যেমন বুঝতে পারতেন তিনি জেনে-শুনে মাদকাসক্ত স্বামীকে গ্রহণ করেছিলেন এবং স্বামীও বুঝতেন অন্য কেউ নয় তিনি নিজেই এই অবস্থার জন্য দায়ী। অন্য কারও সাহায্যের ওপরে শুধু নির্ভরশীল থেকে নয়, তাঁকেই আসলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আসক্তি পুরোপুরি ছাড়ার ব্যাপারে।
এরিক বার্নের মতামত হচ্ছে, আমরা এই মানসিক খেলাগুলো সম্পর্কে যত বেশি সচেতন থাকব এবং এই খেলা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে সক্ষম হব ততই জীবনে কম সমস্যা তৈরি হবে। প্রত্যেকের চিন্তাধারাকে সুস্থ খাতে বইয়ে নেতিবাচক আবেগগুলোকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে—এই বিশ্বাসটি ধরে রাখতে হবে। তা না হলে আমরা চিন্তা না করেই কাউকে আক্রমণ করে বসব বা নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে করে হা-হুতাশ করে অন্যের সহানুভূতি আদায়ের প্রাণপণ চেষ্টায় রত হব অথবা ফলাফল কী হতে পারে, তা না বুঝে কাউকে উদ্ধার করার কাজে লিপ্ত হব। অবশেষে অসম্ভব তিক্ত এক ধরনের অনুভূতি নিয়ে রণাঙ্গন ত্যাগ করব। কাজেই এই মানসিক খেলা থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে সরিয়ে রাখার প্রয়াসের শপথ নিতে হবে সবাইকেই। এতে করে পরিবারে এবং দেশের রাজনীতিতে যে অনেক সুস্থ পরিবেশ তৈরি হবে তাতে সন্দেহ নেই।
ড. মেহতাব খানম: অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.