সময়ের প্রতিধ্বনি-কবে হবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি? by মোস্তফা কামাল

নয়াদিল্লি সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কাছে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল গত সোমবার (৪ জুন) বলেছেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দুই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি সইয়ের জন্য তাঁরা চেষ্টা করছেন।


এর আগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মোৎসব এবং তাঁর অসামান্য সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতার ৯০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে কয়েক দিন আগে ঢাকা সফর করেন ভারতের আইনমন্ত্রী সালমান খুরশিদ। তিনিও ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিস্তা ভারতের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভারতের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে তাঁকে এ বিষয়টি ব্রিফ করা হয়েছে বলে তিনি সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেন। তিনি এও বলেছেন, 'তিস্তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। অবশ্যই অতিদ্রুত তিস্তা চুক্তি সই হবে এবং সেই শুভক্ষণের জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি।'
মে মাসের প্রথমার্ধে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং ভারতের পক্ষে ছিলেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ। বৈঠকের পর ভারতীয় সাংবাদিকরা দীপু মনির কাছে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'তিস্তা চুক্তি সই না হলে দুই দেশের সম্পর্ক বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।'
পরে বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছে যে অভ্যন্তরীণ কারণে তাদের পক্ষে তিস্তা চুক্তি করা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। জোটের শরিকদের আপত্তি উপেক্ষা করে চুক্তি করতে চায় না কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। এটা জানার পরই নাকি দীপু মনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য প্রকাশ্যেই বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তিনি তিস্তা চুক্তি সইয়ের ওপরই গুরুত্বারোপ করেছেন। আমরা যদি দুই দেশের গত এক বছরের সম্পর্ক নিয়ে পর্যালোচনা করি তাহলে এ কথাই বলতে হয়, দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে ভারতের 'গ্রিন সিগন্যাল' পাওয়া যায়নি বলে সম্পর্ক উষ্ণ না হয়ে আরো বেশি শীতল হয়ে পড়েছে।
আমরা জানি, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ঘোর আপত্তি রয়েছে। তা না হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ই তিস্তা চুক্তি হয়ে যেত। শেষ মুহূর্তে মমতা বেঁকে বসায় মনমোহনের ঢাকা সফরই ব্যর্থ হয়ে যায়। এতে মমতার ওপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বেশ ক্ষুব্ধ হয়। জোটের শরিক বলে সেই ক্ষোভ ঝাড়তেও কুণ্ঠিত হন মনমোহন। উপরন্তু কেন্দ্র অনেকটা নমনীয় হয়েই মমতার মন গলাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তারপরও মমতা নিজের অবস্থানেই অনড় থাকেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগিতা ভারতীয়দের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ শেখ হাসিনার সহযোগিতা ছাড়া ভারতের একার পক্ষে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অনেকটাই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সব ধরনের সহযোগিতার ব্যাপারে ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সে দেশের সুধী সমাজ ও গণমাধ্যমের চাপ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর করেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে সই করেন। কিন্তু দুই দেশের সহযোগিতাসংক্রান্ত যৌথ ইশতেহারের কোনো শর্তই পূরণ হয়নি। ভারতের কঠিন শর্তের কারণে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিটি পরিত্যাগ করতে হয়েছে। ভারত যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি। অমীমাংসিত সমস্যাগুলোও দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। ভারতে বাণিজ্য কিছুটা বাড়লেও অশুল্ক বাধায় বাংলাদেশি পণ্য সে দেশের বাজারে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে পারে না। এরই প্রেক্ষাপটে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। কথা ছিল, ড. মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হবে। এ লক্ষ্যে উভয় দেশ সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিল। অথচ শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে চুক্তি সই হয়নি। তখন কেবল সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তিটি সই হয়। অথচ বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে ৪০ বছরের অমীমাংসিত সমস্যাটি ঝুলে আছে। এর ফলে অন্য দুটি সমস্যা- ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর এখনো হয়নি। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে ছিটমহল ও সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষকে। সীমান্তে প্রায়ই গোলাগুলি-রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। শুধু যে তিস্তার কারণে দুই দেশের সম্পর্ক থমকে দাঁড়িয়েছে তা নয়, ভারতের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করা, সর্বোচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্তের পরও ভারতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর মীমাংসা না করা এবং সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। মেনে নিতে পারি না বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের নির্বিচারে হত্যা। এটা সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ নয়। এসব ইস্যুতে যখন বাংলাদেশিদের মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক তখনই ভারত একটি স্পর্শকাতর ইস্যু 'ট্রানজিট' নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। ভারত এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করল, যেন দুই দেশের মধ্যে সবার অগোচরে ট্রানজিট চুক্তি হয়ে গেছে। বেশ কিছু ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসা-যাওয়াও করল। এতে রীতিমতো বিপদে পড়ল সরকার। দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হলো। পরে উভয় পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে বলা হলো, পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করেছিল।
সংগত কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই না হলে এই সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে কি না সন্দেহ। অবিলম্বে তিস্তা চুক্তি সই হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে মনে হয়। একই সঙ্গে চার দশক ধরে ঝুলে থাকা অমীমাংসিত সমস্যাগুলোও মিটিয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এটা উভয় দেশের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম।
আমরা জানি, দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া অত্যন্ত ভালো। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে দুই দেশের সম্পর্ককে আটকে দিলে উভয় দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য তা বিব্রতকর হবে। উভয় দেশের সীমাবদ্ধতা এবং স্পর্শকাতর ইস্যুতে উদ্বেগের বিষয়টিও নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করতে হবে। সম্ভবত সেই উপলব্ধি থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে উভয় পক্ষ।
দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ে দুটি সফর বিনিময়ের ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু কার্যকর কোনো অগ্রগতি আমরা দেখছি না। তিস্তার ব্যাপারে উভয় দেশের রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও যৌথ নদী কমিশন এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতির তথ্য দিতে পারেনি। তাহলে কি বর্তমান সরকারের আমলে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না? অমীমাংসিত সমস্যাগুলোও কি ঝুলেই থাকবে? তাহলে বাংলাদেশ সরকার কেন ভারতের জন্য এত বড় ঝুঁকি নিল? ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা দমনে বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা কি ভারত বিবেচনায় নেবে না?
বাংলাদেশের অব্যাহত বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ভারত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির একটি চুক্তিও করেছিল বাংলাদেশ। সেই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নাকি বাধা দিচ্ছেন। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে ৪০০ কেভির একটি উপকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয় ভারতের পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জমিনীতি আইনের ফাঁদে পড়েছে এই উপকেন্দ্রটি। তা ছাড়া ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা চলছিল। বলা হয়েছিল, ভারতই ত্রিদেশীয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেওয়া হবে তিন দেশের জাতীয় গ্রিডে। কিন্তু প্রস্তাবটি এখনো আলোচনার টেবিলেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন ভারতের পানিসম্পদসচিব ধ্রুব বিজয় সিং। তিনি বলেছেন, ঢাকার সম্মতি ছাড়া বরাক নদের ওপর টিপাইমুখ বাঁধ করবে না ভারত। একই সঙ্গে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে ভারতের দিক থেকে তিস্তার পানি প্রত্যাহারও হবে না। আমরা ভারতের এই ইতিবাচক মনোভাবকে স্বাগত জানাই। তবে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিটি সই করতে পারলে দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে আশা করছি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.