কমরেড জ্যোতি বসু স্মরণে by হায়দার আকবর খান রনো


ভারতের রাজনীতিতে প্রবাদ পুরুষ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসান ঘটেছে ৯৫ বছর বয়সে। ভারতের সর্বস্তরের জনগণ এবং পক্ষে-বিপক্ষের সব রাজনৈতিক নেতা তার প্রতি যে ধরনের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন, তা একটি বিরল ঘটনা।
শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকারি ও বিরোধী দলসহ প্রায় সব দল ও সাধারণ মানুষ। আর কমিউনিস্টরা তো বটেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও অনেক রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ছুটে এসেছেন কলকাতায় তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। অবশ্য এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, তার মরদেহ নিয়ে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে না। তারই ইচ্ছানুসারে তার মরদেহ দান করা হয়েছে হাসপাতালে এবং মৃত্যুর পরপরই তার চোখ দান করা হয়েছে একটি সংগঠনকে, যারা অন্ধব্যক্তিদের চোখ দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। ঠিক এমনটি করেছিলেন আমাদের দেশের অধ্যাপক আহমদ শরীফ ও অন্য অনেকে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ ঘোষণা দিয়ে নাস্তিক ছিলেন। কিন্তু তার চোখ দিয়ে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিল কোরআনে হাফিজ এক দুর্ভাগা অন্ধ যুবক।

যাই হোক, সে প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। আমরা এখানে দেখার চেষ্টা করব কমরেড জ্যোতি বসুর এমন বিরল জনপ্রিয়তার বিশেষ কারণ কী? এক কথায় তার উত্তর হলো, তিনি মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, সে জন্য মানুষ তাকে মনে রেখেছে। কমিউনিস্ট হিসেবে তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি সংগ্রামের অবিচল, নিষ্ঠাবান, সাহসী সৈনিক ও সেনানায়ক। তিনি বড় মাপের মার্কসবাদী পণ্ডিত ছিলেন না। কিন্তু মার্কসবাদের সারমর্ম বুঝেছিলেন খুব ভালোভাবে এবং তার প্রয়োগ করে গেছেন তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা ও প্রখর বাস্তববুদ্ধি দিয়ে। অবশ্য এর সঙ্গেও নিশ্চয় ছিল এমন আরও কিছু নেতৃত্বের গুণাবলী, যা তাকে মহান নেতায় পরিণত করেছিল।
জ্যোতি বসুর জন্ম বাংলাদেশে। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের বারদী গ্রামে। সেখানেই তার পৈতৃক ভিটা। সে জন্য বোধহয় বাংলাদেশের প্রতি একটি বিশেষ দরদ ছিল। বলা যায়, খানিকটা নাড়ির টান ছিল। ১৯৯৬ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে না থাকলেও ঢাকায় এসেছিলেন গঙ্গার পানিচুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে। তখন দেখেছি তার বিশেষ আগ্রহ ও উদ্যোগ ছিল, যাতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থরক্ষা হয়। ১৯৭১ সালেও দেখেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তার ভূমিকা। কমরেড জ্যোতি বসুর মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন প্রকৃত অকৃত্রিম বন্ধুকে।
বারদী গ্রামে জন্ম হলেও জ্যোতি বসুর বাল্যকাল কেটেছে কলকাতায়। সেখানেই তথাকথিত অভিজাত স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছিলেন। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারে, যে পরিবারের মধ্যে অবশ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বদেশি চেতনা কাজ করত। কিন্তু তখনও তিনি মার্কসবাদের সংস্পর্শে আসেননি। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। তারপর তিনি বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে। বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি ব্যারিস্টারি পাস করার পাশাপাশি আরেকটি অনেক বড় অর্জন করেছিলেন। তা হলো মার্কসবাদে দীক্ষা গ্রহণ, যা ছিল তার পরবর্তী জীবনের চলার পথে সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয়। লন্ডনে তাকে মার্কসবাদী হতে সাহায্য করেছিলেন ব্রিটেনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হ্যারি পলিট, রজনী পামদত্ত, বেন ব্রাডলি প্রমুখ। ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু দেশে ফিরে এলেন কমিউনিস্ট হয়ে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদের হাত ধরে তিনি যোগ দিলেন পার্টিতে। ব্যারিস্টারি আর করেননি। করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ, তাও আবার সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে।
জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায় হলো ব্রিটিশ আমলে চল্লিশের দশক, যখন তিনি প্রধানত শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায় হলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশক যখন তিনি শাসক কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তৃতীয় পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রূপে। সংসদীয় কাজ, মুখ্যমন্ত্রিত্বের কাজ ও রাস্তার গণআন্দোলনের কাজের পাশাপাশি একই সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত কাজ, পার্টির ভাঙাগড়ার কাজের সঙ্গে। প্রায় প্রথম থেকেই জ্যোতি বসু ছিলেন পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা।
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান তরুণ ব্যারিস্টার কমরেড মোজাফফর আহমদের নির্দেশে রেলওয়ে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নে কাজ শুরু করেন। শ্রমিক আন্দোলনের কাজে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন, শ্রমিক কলোনিতে থেকেছেন। পাশাপাশি তিনি ট্রামে-বাসে-রাস্তায় পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন। তিনি ছিলেন পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। এভাবে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলেন।
১৯৪৬ সালের নিখিল বঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের জন্য পার্টির পক্ষ থেকে তিনি নির্বাচন করেন। তখন রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনী এলাকা ছিল। সেখানেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেসের প্রার্থী হুমায়ুন কবীর, যার তখন ছিল ব্যাপক নামডাক। নির্বাচনে জ্যোতি বসু বিজয়ী হয়েছিলেন। এ বিজয়টি ছিল বিস্ময়কর। কারণ জ্যোতি বসু তখনও স্বল্প পরিচিত। ওই নির্বাচনে বঙ্গদেশের প্রাদেশিক পরিষদে আর দু’জন কমিউনিস্ট প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন—দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিক নেতা কমরেড রতন লাল ব্রাহ্মণ ও দিনাজপুরের কৃষক নেতা রূপনারায়ণ রায়। তিনজনের এক ছোট কমিউনিস্ট গ্রুপের নেতা কমরেড জ্যোতি বসু। সংসদীয় রাজনীতিতে এই তার প্রথম যাত্রা। কৃষ্ণধর লিখেছেন, ‘তিন সদস্য নিয়ে গঠিত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে তখনই তিনি আইন সভার মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ... অত্যন্ত ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে তরুণ ও স্বল্প পরিচিত জ্যোতি বসুর দক্ষতা এবং সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করার ভঙ্গি ও ভাষা অল্প সময়ের মধ্যেই সভার ভেতরে-বাইরে, সংবাদপত্রে ও সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।’
স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচনে (১৯৫০ সালে) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে ওঠে প্রধান বিরোধী দল এবং জ্যোতি বসু ছিলেন পার্টির সংসদ দলীয় নেতা। এর আগে দুই বছর ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ছিল এবং কমিউনিস্টদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়েছিল নেহরুর কংগ্রেস সরকার। জ্যোতি বসু কেবল সংসদের মধ্যে বিরোধী দল হিসেবেই ভূমিকা রাখেননি। তিনি রাস্তার সংগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাকে জীবনে বহুবার জেল খাটতে হয়েছে, কখনও কখনও আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। সংসদীয় কাজই নয়, বরং গণসংগ্রামসহ বিশেষ করে মেহনতী মানুষের মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম ছিল তার জীবনের মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কয়েকটি বড় মাপের গণসংগ্রাম হয়েছিল। তার মধ্যে খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং শিক্ষকদের আন্দোলন অন্যতম। এ সময়টিতেই সামনের সারিতে ছিলেন জ্যোতি বসু। জনগণের পক্ষে লাগাতার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জ্যোতি বসু জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মতাদর্শগত প্রশ্নে বিভক্তি হয়েছিল। স্টালিন-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নকে যারা সংশোধনবাদী আখ্যায়িত করেছিলেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন করেছিলেন (যা সাধারণভাবে ঈচগ নামে পরিচিত) জ্যোতি বসু তাদের অন্যতম ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ঈচগ গঠনের সময় থেকেই তিনি এ পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ছিলেন। সেই সময় ভারতের কংগ্রেস সরকারের চরিত্র নিয়েও পার্টির মধ্যে বিরোধ ছিল। জ্যোতি বসু ও তার পার্টি CPI (M) নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ও ভারতের রাষ্ট্রকে জমিদার ও বৃহত্ বুর্জোয়ার সরকার বা রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছিল। ভারত সরকার চীনকে আগ্রাসী ঘোষণা করে চীনবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী জঙ্গি প্রচারে নেমেছিল। কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশ তা মনে করত না, যারা পরবর্তীকালে CPI (M) গঠন করেন, তারাই নেহেরু সরকারের রোষের মুখে পড়েছিলেন। কমরেড মোজাফফর আহমদসহ অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। জ্যোতি বসুকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যখন উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার তুঙ্গে, তখন জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক চীন আগ্রাসী নয়, বরং ভারত সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছে।
ওই পরিস্থিতিতে এমন সত্য কথা বলতে যে হিম্মত লাগে তা জ্যোতি বসু ও তার পার্টির ছিল। অবশ্য তীব্র ও উগ্র জাতীয়তাবাদী স্রোতের কারণে সাময়িকভাবে CPI (M) গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা অল্প কয়েক দিনের জন্য। পার্টি আবারও শ্রমিক কৃষক আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে স্থান করে নিতে পেরেছিল, যার ফল পাওয়া গেল ১৯৬৭-এর নির্বাচনে, যখন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় CPI (M) সর্ববৃহত্ দল রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
জ্যোতি বসু ও CPI (M) তদানীন্তন সোভিয়েত লাইনের বিরোধিতা করলেও তারা চীনের অন্ধ সমর্থক ছিলেন না। তদানীন্তন চীন পার্টির ত্রিবিশ্ব তত্ত্ব এবং অন্যান্য অনেক বাম বিচ্যুতি ও ভুল লাইনের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল থেকে, শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতাবাদে দৃঢ় থেকে স্বাধীন লাইন গ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলেই ওই পার্টির বিকাশ ঘটেছিল। এর থেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কমিউনিস্টরাও শিক্ষা নিতে পারেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় CPI (M) বিরোধী দলে থাকলেও এবং তাদের ওপর পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরায় কংগ্রেসি সরকারের দমন-পীড়ন চললেও তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং অনেকাংশে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময় কতিপয় বাম সংগঠন একত্রিত হয়ে গঠন করেছিল ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।’ তারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নিয়েও স্বতন্ত্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেছিলেন, যাদের নেতৃত্বে ছোট-বড় ১৪টি সশস্ত্র গেরিলা ঘাঁটি ছিল। CPI (M) তাদের সমর্থকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ এই বাম সংস্থাকে সাহায্য করেছিলেন। তা ছাড়া তখন ভারতে বামপন্থীদের চলাফেরা বেশ অসুবিধাজনক ছিল। জ্যোতি বসু ও CPI (M) বাম কমিউনিস্ট কর্মীদের এবং কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তার ও আশ্রয়দানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি একবার আমাদের বলেছিলেন, ‘আমরা অস্ত্র দেয়া ছাড়া আর সব রকম সাহায্য করব। কারণ অস্ত্রের ব্যাপারটি তো কেন্দ্রের হাতে।’ জ্যোতি বসু প্রকাশ্যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, ‘মওলানা কোথায় আমরা জানতে চাই।’ কারণ সে সময় মওলানা ভাসানী গৃহবন্দি অবস্থায় ছিলেন।
১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৪ বছর জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে বার্ধক্যের কারণে মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদ ছেড়ে দিলেও ওই দায়িত্বটি তুলে দিয়েছেন তার দলেরই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। এ দীর্ঘ সময়ে জ্যোতি বসু ও তার পার্টিকে কেন্দ্রের কংগ্রেস বা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করেই নির্বাচনে জিততে হয়েছে। কেন্দ্রের বিরোধিতার মুখে কয়েক দশক ধরে বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে বলে আমার জানা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতার মুখে এত দীর্ঘ সময় ধরে রাজ্য সরকার দখলে রাখা বিস্ময়ের বিষয় বৈকি। এর মূল কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার, জনগণের বিশেষ করে গরিব জনগণের পক্ষে কয়েকটি কাজ করতে পেরেছিলেন। সেগুলো হচ্ছে—১. ভূমি সংস্কার, যার দ্বারা জমিদার-জোতদারদের উচ্ছেদ করে খোদ কৃষকের হাতে জমি দেয়া হয়েছিল, ২. বর্গা অপারেশন, যার দ্বারা বর্গা কৃষকরা জমিতে চাষ করার স্থায়ী অধিকার ও ফসলের ন্যায্য অংশ পেয়েছিল, ৩. পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রামের গরিব জনগণকে ক্ষমতার স্বাদ প্রদান এবং ৪. শিল্পায়ন।
বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য বিধায় গোটা দেশের বুর্জোয়া অর্থনীতির বাইরে বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়। CPI (M) নিজেরাও স্বীকার করে যে, তারা কিছু সংস্কার করছে মাত্র। বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা রাজ্য সরকারকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব তা হলো এই বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যেও জনগণের পক্ষে কিছু সংস্কার করা এবং রাজ্য ক্ষমতাকে শ্রেণী-সংগ্রামের স্বার্থে কাজে লাগানো। তারা যা করেছে তা যে কোনো সত্, দেশপ্রেমিক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুর্জোয়া সরকারের পক্ষেও করা সম্ভব, যদি তেমন কোনো বুর্জোয়া দলের সেই ধরনের জনকল্যাণমুখী কাজের জন্য আন্তরিক ইচ্ছা থাকে। পশ্চিবঙ্গের ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আমাদের মতো দেশের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে। কিন্তু হায়! আমাদের দেশে তেমন কোনো দল এখনও পর্যন্ত ক্ষমতায় আসেনি।
এ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক এবং জাতপাতের বিষয়গুলো ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক অনেক কম।
এসব কৃতিত্ব জ্যোতি বসুর। তবে শুধু জ্যোতি বসু একারই নন, একটি আদর্শ, নিষ্ঠ ও সুশৃঙ্খল পার্টিরও কৃতিত্ব। জ্যোতি বসু যেমন পার্টিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন; তেমনি পার্টিও জ্যোতি বসুকে বড় নেতা বানিয়েছে। এ দুইয়ের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে তা ভুলে গেলে চলবে না। কমরেড মোজাফফর আহমদ এ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত ও অন্য নেতারাও বহু ত্যাগ, আদর্শ নিষ্ঠা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্টিকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন।
জ্যোতি বসু সম্পর্কে আমাদের দেশে সাধারণভাবে প্রচার আছে, তিনি মূলত সংস্কারবাদী বা আধা বুর্জোয়া। এটি একেবারেই ভুল। জ্যোতি বসু পার্টির প্রতি যে কত অনুগত ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদটি পার্টির নির্দেশে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
জ্যোতি বসু সাধারণভাবে স্বল্পভাষী। আমাদের দেশে আবেগময়ী বা জ্বালাময়ী বা নাটকের ঢং-এ বক্তৃতা দেয়ার প্রবণতা আছে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতার মধ্যে, তা জ্যোতি বসুর বক্তৃতায় পাওয়া যাবে না। তিনি যেন লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে সহজ ভাষায় কথা বলেন। জটিল বিষয়কে সহজে অল্প কথায় ব্যাখ্যা করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল তার। এক ব্যতিক্রমধর্মী নেতা ছিলেন তিনি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন মার্কসবাদে আস্থাশীল বিপ্লবী নেতা, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রখর বাস্তবজ্ঞান।
জ্যোতি বসুকে হারিয়ে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক অকৃত্রিম বন্ধুকে, আর ভারত হারিয়েছে তাদের প্রিয় নেতাকে। ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। জ্যোতি বসুকে আমরা আরও বাঁচিয়ে রাখতে পারি এ উপমহাদেশে মার্কসবাদের বিকাশ ঘটিয়ে এবং সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে জোরদার করে। যুগ যুগ জিয়ো কমরেড জ্যোতি বসু।

No comments

Powered by Blogger.