প্রবাসে কর্মরত নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেনঃ তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে


বিদেশে জনশক্তি রফতানি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের এই যে রমরমা, তার একটা বড় কারণ প্রতি মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো মোটা অংকের রেমিটেন্স।
বিদেশে শ্রম বিক্রিতে নিয়োজিত বাংলাদেশীদের মধ্যে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০০৫-২০০৬ সালে প্রায় ১৪ হাজার মহিলা শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গেছেন। ২০০৬-২০০৭ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১৮ হাজারে দাঁড়ায়। এক পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২০ হাজার ৮৪২ জন মহিলা শ্রমিক চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। কিন্তু এদের অবস্থা সম্পর্কে ইউএনডিপির এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শনিবার আমার দেশ যে খবর ছেপেছে তা রীতিমত হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশে বাংলাদেশী মহিলা শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ যৌন হয়রানি ও অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হন। তাদের অনেকে চুক্তি অনুযায়ী বেতন পান না। দেশে ফিরে এসে ওইসব নির্যাতিত নারী শ্রমিক ট্রাভেল এজেন্ট, কর্মস্থলের ঠিকানা ও মালিকের নাম দিতে না পারায় তাদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না। এই নারী শ্রমিকদের গরিষ্ঠ অংশ অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রাম্য মহিলা। তাদের মধ্যে যারা ভাগ্যবতী তারা চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার আগে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ পান। অতি অল্প সময়ের এই তথাকথিত প্রশিক্ষণ বাস্তবে তাদের কোনো কাজে আসে না। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ নারী শ্রমিক বিদেশে যান কোনো দালাল, আত্মীয় বা অন্য কোনো মাধ্যমে। বিদেশে গিয়ে তারা কী কাজ করবেন তার কোনো দিকনির্দেশনা থাকে না। দেশে অনেক ছোট ছোট রিক্রুটিং এজেন্সি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যারা বিদেশে জনশক্তি রফতানি করে। কিন্তু তাদের রেকর্ড নেই। ন্যূনতম মানদণ্ডের বালাই নেই। আমাদের দেশ থেকে মাত্র ৯ শতাংশ নারী শ্রমিক যথাযথ প্রক্রিয়ার সব কিছু সম্পন্ন করে বিদেশে যান। ফলে বাদবাকিরা, যাদের একটা বিরাট অংশ আবার অক্ষরজ্ঞানহীন, বিদেশে গিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়েন। কপাল চাপড়ানো আর নীরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া তাদের আর করার কিছু থাকে না। যৌন হয়রানি, নানান নির্যাতন ও বঞ্চনা ছাড়াও ঘাতক ব্যাধি এইডসে আক্রান্ত হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তারা।

অথচ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা শ্রমিক প্রেরণকারী এবং নিয়োগকারী উভয় দেশেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অবস্থা নানান পারিপার্শ্বিক কারণে অধিকতর ভঙ্গুর বিধায় তাদের বেলায় এ দায়িত্ব অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে পালন করা উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকদের মানবিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। শুধু অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি প্রায়ই অবহেলিত থাকে। বিশ্বব্যাপী অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে জাতিসংঘ ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে ‘অভিবাসী শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেশন’ প্রণয়ন করে। কনভেনশনের আলোকে অভিবাসী শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট পক্ষ নিজ নিজ অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হলে ও এর নীতিমালা অনুসরণ করলে শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি শ্রমিকরা প্রেরণকারী ও নিয়োগকারী উভয় দেশেরই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে গতর খেটে যারা দেশে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন তাদের ভালো-মন্দ দেখাশোনা করার ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। বরং এ ব্যাপারে সরকারি উদাসীনতা চরমে বললেই সত্য বলা হয়। এ কথা অতীতের সরকারগুলোর ব্যাপারেও সমভাবে প্রযোজ্য। এ দেশের নারী শ্রমিকরা অধিক থেকে অধিকতর হারে বিদেশে যাচ্ছেন শ্রমের বিনিময়ে নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্ন যদি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়, এই দুঃস্বপ্নের ভার যদি আজীবন বাইতে হয় তবে দেখার কেউ থাকবে না—এ কেমন কথা। বলা হয়ে থাকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অবহেলা, অযোগ্যতা এবং অতিলোভ বিদেশে আমাদের নারী শ্রমিকদের নিগ্রহের প্রধান কারণ। এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সোজা পথে আসতে বাধ্য করার দায় সরকারের। উপরন্তু শ্রমিক নিয়োগকারী দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ দায়িত্ব পালনে সরকার সফল না হওয়া পর্যন্ত বিদেশে বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের নিগ্রহ চলতেই থাকবে। তাই অবিলম্বে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.