ভারত টিপাইমুখ বাঁধ দিতে চাইছে ’৭২ সাল থেকেঃ এ ব্যাপারে প্রেম দেখানোর সুযোগ নেই

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করছেন যে, তার এবারকার ভারত সফর শতভাগ সফল হয়েছে। এ সাফল্যের নমুনা হিসেবে টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে তিনি একাধিকবার বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হবে এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত নেবে না।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং দেশবাসীকেও আস্থা রাখতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মতো আমরাও ড. সিংয়ের কথায় আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু কোনটা ‘বড় ধরনের ক্ষতি’ আর কোনটা ‘সামান্য ক্ষতি’ তা নির্ধারণ করা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় আমরা দেখি ‘শত সখী সনে’ গঙ্গাস্নান করার পর কাশীর মহিষী করূণা ভীষণ শীতকাতর হয়ে পড়েছিলেন। স্নান শেষে রাজপ্রাসাদে ফেরার পথে গরিব প্রজাদের অনেকগুলো পর্ণকুটির ছিল। তিনি এই কুটিরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে শীত নিবারণের ব্যবস্থা করেছিলেন; সখীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী শীত নিবারিব অনলে।’ পরে এ ব্যাপারে রাজার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, এতে নাকি প্রজাদের সামান্য ক্ষতি হয়েছে। অতএব, টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় আমরা যদি ভাসতে, ডুবতে এবং শুকাতে থাকি আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি সেটাকে বাংলাদেশের জন্য ‘সামান্য ক্ষতি’ মনে করেন তবে তো তিনি কথা রাখেননি— এ অপবাদ দেয়া যাবে না! কারণ তিনি ‘বড় ধরনের ক্ষতি’ না করার কথা বলেছেন, ‘সামান্য ক্ষতি’ও করবেন না তেমন আশ্বাস দেননি। তাই, মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসের কল্যাণে ভারত টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নেবে, তেমন আশা না করাই ভালো। কারণ দিল্লির এ বাঁধ নির্মাণের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের।
আমার দেশ-এ গতকাল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ২৫ ও ২৬ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) প্রথম বৈঠকেই ভারত বরাক নদীতে পানির রিজার্ভার গড়ে তোলার প্রসঙ্গ তুলেছিল। ভারতীয় প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, বাংলাদেশে বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমানোর স্বার্থে এ রিজার্ভার গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা দরকার। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ভারতের প্রস্তাবে এক কথায় রাজি না হওয়ায় একটি যৌথ স্টাডি গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জেআরসির ২য় বৈঠকে; ১৯৭৩ সালের ৮-১০ নভেম্বর ঢাকায় জেআরসির ষষ্ঠ বৈঠকে; ১৯৭৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত দিল্লিতে জেআরসির সপ্তম বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। যদিও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে বরাক নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ভারতের মনিপুর রাজ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভের ফলে ভারতের বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবটি দীর্ঘদিন হিমাগারে পড়ে ছিল।
দেখা যাচ্ছে, ভারতের মনিপুর রাজ্যে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের মুখে বরাক নদীতে বাঁধ নির্মাণের বাসনা একবার পরিত্যক্ত হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে মনিপুরবাসী ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। ঠিক একই কারণে বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অতএব, ভারতবিদ্বেষে অন্ধ হয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করছে বলে যে যুক্তি তুলে ধরা হয় তা ধোপে টেকে না। মহাজোট সরকারের ছোট শরিক জাতীয় পার্টির অন্যতম নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি সম্প্রতি এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেছেন, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশই টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ সেই ১৯৭২ সাল থেকে। তাই জনাব মাহমুদের বক্তব্য ধোপে টেকে না। তবে এমন হতে পারে যে, মনিপুরবাসীর প্রবল আন্দোলনের ফলে থেমে যাওয়া প্রক্রিয়াটি দিল্লি আবার চাঙ্গা করতে চেয়েছিল ১৯৮৮ সালে তত্কালীন এরশাদ সরকারের মাধ্যমে। সেই সরকারের চরিত্রের সঙ্গে অবশ্য ব্যাপারটা খাপে খাপে মিলে যায়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারত বারবার চেষ্টা করেও বরাক নদীতে বাঁধ দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সম্মতি আদায় করতে পারেনি। কারণ ফারাক্কার ব্যাপারে একবার ‘হ্যাঁ’ বলায় বাংলাদেশ কী গেরোর মধ্যে পড়েছিল বঙ্গবন্ধু সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন। পূর্বাপর বিবেচনা করে তাই বলতে হয়, মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসবাণীতে মোহিত হয়ে আমরা যদি গদগদ নিষ্ক্রিয়তায় আপ্লুত হই তবে আমাদের চরম মাশুল গুনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.